আজকের আধুনিক সৈয়দপুরের শুরুটা ছিল আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েকে ঘিরে। এর আগে সৈয়দপুর ছিল সাধারণ গ্রাম। পলাশীর যুদ্ধে বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হওয়ার পর ব্রিটিশরা নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থেই এদেশে গড়ে তুলতে থাকে রেলপথ। এরই এক পর্যায়ে সৈয়দপুর হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। দীর্ঘ ১শ’ ৩০ বছর অথবা তারও আগেকার কথা। সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন গড়ে উঠার পর এই অঞ্চলে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। বিস্তৃতি ঘটতে থাকে শহরের। তারপরই ১৮৭০ সালে ইংরেজ বেনিয়ারা সৈয়দপুরে প্রতিষ্ঠা করে বিশাল রেলওয়ে কারখানা, যা আজও বাংলাদেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা হিসাবে বিবেচিত। সে সময় ইংরেজদের চিত্তবিনোদনের জন্য এখানে একটা সুরম্য মিলনায়তন গড়ে তোলা হয়। নাম ছিল ‘দি ইউরোপিয়ান ক্লাব’। পরবর্তীতে এর নামকরণ করা হয় মুর্তজা ইন্সটিটিউট। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা বিস্তৃতির কারণে এখানে ইউরোপিয়ানদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ইংরেজ সাহেবরা বিকালে ক্লাবে এসে জড়ো হতো, সঙ্গে থাকতো তাদের স্ত্রী অথবা বান্ধবীরা। তারা নিজেদের ইচ্ছা ও রুচি অনুযায়ী আমোদ-ফুর্তি করতো এই ক্লাবে। ক্লাবের এই অবস্থা ১৯৩০ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। এরপর থেকে ক্লাবের নিয়ম-কানুন কিছুটা শিথিল করা হয়। ১৯৩০ সালের আগে এ ক্লাবে ভারতীয়দের প্রবেশ একেবারে নিষিদ্ধ ছিল।
পরবর্তীকালে সাহেবদের পাশাপাশি ভারতীয় রেল কর্মকর্তারাও এ ক্লাবে প্রবেশের সুযোগ লাভ করে। পায় সদস্য পদ। এ সময় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন বিআর সিং। তাঁর নামানুসারে রেলওয়ে ময়দানের পশ্চিম পার্শ্বে একটি ভবনের নামকরণ করা হয় বিআর সিং ইন্সটিটিউট। যা বর্তমানে সৈয়দপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। পরবর্তীকালে ইউরোপিয়ান ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে বিআর সিং ক্লাব রাখা হয়। এ নামই পরে কালোপেপার ইন্সটিটিউট এবং আরও পরে মুর্তজা ইন্সটিটিউট রাখা হয়।
মূলত ১৯৩০ সালের পর থেকেই এ ইন্সটিটিউটে ইউরোপীয় সংস্কৃতির পরিবর্তে দেশীয় নাটক, যাত্রাপালার বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্থান পায়। তখন থেকেই এ অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ইংরেজ সাহেবরাও তখন একে একে স্বদেশ ফিরতে থাকেন। ফলে এই ইন্সটিটিউটের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেন ভারতীয় কর্মকর্তারাই। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর ইন্সটিটিউটের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারীর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় মুর্তজা ইন্সটিটিউট। মুর্তজা সে সময় সৈয়দপুরস্থ বিভাগীয় মেডিক্যাল অফিসের হেডক্লার্ক ছিলেন। ওই সময় মূলত ইন্সটিটিউটটি সংস্কার ও সমপ্রসারণ কাজ সম্পন্ন করা হয়। বর্তমানে এই ইন্সটিটিউটে নিজস্ব প্রয়োজন ছাড়াও শহরের অন্যান্য নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের অনুষ্ঠান এখানে মঞ্চায়ন করছে। মুর্তজা ইন্সটিটিউটের মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে এর গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারে আছে প্রাচীনকালের দুষপ্রাপ্য কিছু গ্রন্থ। গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার।
এছাড়া সংগ্রহে রয়েছে বাংলা ও ইংরেজী ভাষার অনেক বই। রয়েছে অতীতকালের সাক্ষী কিছু পত্র-পত্রিকাও। এছাড়া সংগ্রহে থাকা মূল্যবান বাদ্যযন্ত্র ও চিত্রকলা ইতিমধ্যে খোয়া গেছে। এই মুহূর্তে অতীত ঐতিহ্য রক্ষায় এই মুর্তজা ইন্সটিটিউটটি মেরামত ও সংস্কার করে আধুনিক উপযোগী করার জন্য সচেতনমহল দাবি জানিয়েছেন। লাল ইটের গাঁথুনির উপর দাঁড়ানো এ ভবন আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
0 comments:
Post a Comment