Sunday, August 19, 2012

নবরত্ন মন্দির, হাটিকুমরুল; সিরাজগঞ্জ

17 comments
সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হাটিকুমরুল। গ্রামটি হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত। পাখির কোলাহল আর ছায়া সুনিবিড় সবুজে ঘেরা এ হাটিকুমরুল এলাকায় নবরত্ন মন্দির অবস্থিত। ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। নবরত্ন মন্দিরের গঠন, আকৃতি ও নির্মাণশৈলী এতই অভূতপূর্ব যে দেশীয় পর্যটক ছাড়াও জার্মান, জাপান, ফ্রান্স, আমেরিকা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা এখানে ঘুরতে আসেন। তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং মন্দিরের আশপাশের জায়গাগুলো দখলমুক্ত করে পর্যটকদের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে নবরত্ন মন্দির হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।
জানা যায়, মথুরার রাজা প্রাণনাথের বন্ধুভাজন ব্যক্তি ছিলেন জমিদার রামনাথ ভাদুড়ী। রাজা প্রাণনাথ দিনাজপুর জেলার ঐতিহাসিক কান্তজীর মন্দির নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় করে সংকটে পড়ে যান। এদিকে রামনাথ ভাদুড়ী রাজা প্রাণনাথকে রাজস্ব পরিশোধ করার জন্য তাকে চাপ দেন। কিন্তু রাজা প্রাণনাথ বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হলে রামনাথ ভাদুড়ী বন্ধুত্বের খাতিরে নিজ কোষাগার থেকে প্রাণনাথের বকেয়া পরিশোধ করে দেন। বিনিময়ে তিনি রাজা প্রাণনাথকে দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরের আদলে হাটিকুমরুলে একটি মন্দির নির্মাণের শর্ত জুড়ে দেন। বন্ধুর দেওয়া শর্ত মোতাবেক রাজা প্রাণনাথ কান্তজীর মন্দিরের অবিকল নকশায় হাটিকুমরুলে এই নবরত্ন মন্দির নির্মাণ করেন। আবার অন্য সূত্রে জানা যায়, রাখাল জমিদার নামে পরিচিত রামনাথ ভাদুড়ী তার জমিদারি আয়ের সঞ্চিত কোষাগারের অর্থ দিয়েই এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

মন্দিরের বিশাল চত্বরে বিক্ষিপ্তভাবে আরও তিনটি মন্দির রয়েছে। নবরত্ন মন্দিরের উত্তরে শিব পার্বতী মন্দিরের পাশেই রয়েছে দোচালা চণ্ডি মন্দির, দক্ষিণ পাশে পুকুরের পাড় ঘেঁষে রয়েছে পোড়া মাটির টেরো কোটা কারুকার্য খচিত শিবমন্দির। এই চারটি মন্দিরেই পূজা-অর্চনা করা হতো। তার পর কালের বিবর্তনে ভারত উপমহাদেশে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত, দেশ বিভাগ ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে হারিয়ে যায় জমিদারের পূর্বপুরুষরা। যুগ যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে ঝোপঝাড় বুকে নিয়ে লুকিয়ে ছিল এই নবরত্ন। অরক্ষিত এই নবরত্নের অনেক মূল্যবান প্রাচীন সামগ্রী লুট করে নিয়ে গেছে দেশি-বিদেশি দুর্বৃত্তরা। পরে স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহ্যের এই নিদর্শন খুঁজে বের করে। বিশেষজ্ঞদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নবরত্ন মিসরের পিরামিডের মতো ধীরে ধীরে ফিরে পেতে থাকে প্রাচীন ঐতিহ্যসহ তার হারানো অপরূপ সৌন্দর্য। এর পর ১৯৮৭ সালে সংরক্ষিত ইমারত হিসেবে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ গ্রহণ করে নবরত্ন মন্দির ও এর আশপাশের মন্দিরের কিছু সংস্কার সাধন করে।

নবরত্ন মন্দির দেখার জন্য প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে শত শত দর্শনার্থী হাটিকুমরুলে আসে। এ ছাড়া মন্দিরটির অভূতপূর্ব নির্মাণশৈলী দর্শনের জন্য জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, আমেরিকা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা এখানে আসে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে নিজ জেলার দর্শনার্থীদের সমাগম কম লক্ষ্য করা যায়। ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার হাঁটার রাস্তা, খানাখন্দকে ভরা একটু বৃষ্টি হলেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। পর্যটকদের জন্য রাস্তাটা পাকা করা অনেক আগেই জরুরি ছিল। নবরত্ন মন্দিরটির চার পাশে প্রায় ২০০ ঘর হিন্দু পরিবার বসবাস করে। মূল মন্দিরের পাশেই হিন্দুদের পূজা-অর্চনার একটি জরাজীর্ণ মন্দির রয়েছে। এটাও মূল মন্দিরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মেরামত করা দরকার। নবরত্ন মন্দিরের চার পাশে জায়গাগুলো দখলমুক্ত করে পর্যটকদের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে নবরত্ন মন্দির হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। ফলে সলঙ্গা থানার পরিচিতি ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান সরকারের কাছে এটাই এলাকাবাসীর প্রত্যাশা।

*আবদুস সামাদ সায়েম, সিরাজগঞ্জ

17 comments:

Post a Comment