Saturday, September 25, 2010

আগ্নেয়গিরি

0 comments
ভলকানো মানে আগ্নেয়গিরি। পৃথিবীতে অনেক পাহাড় রয়েছে, যা থেকে উত্তপ্ত গলিত পাথর, ছাই আর গ্যাস বের হয়। সেই গলিত পাথর, ছাইগুলোর তাপমাত্রা এতই বেশি যে তা টকটকে আগুনের মতো হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ভূ-গর্ভে চাপা থাকার পর একসময় সেই আগুন বেরিয়ে আসে। আর এসব আগুনমুখো পাহাড়কেই বলে আগ্নেয়গিরি।

ভলকানোর নামকরণ নিয়ে মজার একটি কাহিনী রয়েছে। রোমান পৌরাণিক কাহিনীতে আগুনের দেবতার নাম ভালকান (Vulcan)। মূলত সেখান থেকেই ভলকানো নামের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। বাংলায় যা আগ্নেয়গিরি ইংরেজিতে তা ভলকানো (Volkano)। আগ্নেয়গিরি হলো পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ জমা হওয়া গ্যাস, তাপ, চাপের বহিঃস্ফুরণ। পৃথিবীর ভিতরের দিকে যে গ্যাসগুলো জমা হয়, সেগুলো আবার অতিরিক্ত তাপ ও অতিরিক্ত চাপের ফলে পৃথিবীর ফাটল দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। বিষয়টি অনেকটা রান্নার সময় প্রেসার কুকারের সিটি দেওয়ার মতো। ওই যে হঠাৎ করে জোরে আওয়াজ করে উঠে! এই সিটি বাজে প্রেসার কুকারের ভিতরে চাপ বাড়তে থাকার কারণে। আগ্নেয়গিরিতেও প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে। আর বের হওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসে ভিতরে জমে থাকা গলিত লাভা (Lava)। মাটির নিচে জমতে থাকা গলিত পাথর, ছাই প্রভৃতিকে বলে ম্যাগমা (Magma)। সেই ম্যাগমাই যখন মাটির ভিতর থেকে বাইরে খোলা বাতাসে আসে, তখন তার নাম হয় লাভা। লাভার তাপমাত্রা থাকে ৭০০-১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সে কারণে এই তাপমাত্রায় পাথর গলে যাওয়া খুব একটা কঠিন কিছু নয়। আর এই গলিত পাথর বের হয়ে আসাকেই বলে লাভা উদগীরণ।

পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫১০টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আবিষ্কৃত হয়েছে। যার মধ্যে ৮০টি বা তার বেশি আবার সমুদ্রের নিচে। সংখ্যাটাকে অনেক বেশি মনে হতে পারে। কিন্তু তার চেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে পৃথিবীতে প্রতি ১০ জনের একজন বাস করে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির আওতায়। যদিও এটি ভয়াবহ বিপজ্জনক, তারপরও মানুষ আগ্নেয়গিরির কাছেই থাকে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, গত ৫০০ বছরে কমপক্ষে ২ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেছে এই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে। অথচ তারপরও মানুষ থাকতে চায় আগ্নেয়গিরির কাছে, কারণ আগ্নেয়গিরির ঢালে থাকে উন্নত এবং উর্বর মাটি, যাতে ফসল ভালো হয়। আর অনেক পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টিই হয়েছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে। এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপের কথাই ধরা যাক। এটি পাঁচটি পর্বত নিয়ে গঠিত। আর এই পাঁচটি পর্বতের ২টিই আগ্নেয়গিরি!

আগ্নেয়গিরিগুলোকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। সক্রিয়, সুপ্ত এবং বিলুপ্ত। সক্রিয় আগ্নেয়গিরি প্রায়ই অগ্ন্যুৎপাত করে এবং যেকোনো সময় করতে পারে। সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হলো যে আগ্নেয়গিরি বেশ আগে অগ্ন্যুৎপাত করেছে আবার যেকোনো সময় করতে পারে। আর বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরি হলো যেটা অনেক দিন আগে অগ্ন্যুৎপাত করেছে, আর করার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সক্রিয় আগ্নেয়গিরি হলো মাওনা লোয়া (Mouna Loa)। হাওয়াই ভাষায় মাওনা লোয়া মানে হলো লম্বা পর্বত। এটি প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপে। মাওনা লোয়া ৪ হাজার ১৭০ মিটার লম্বা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, এটি মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও বড়। অবশ্য তা সমুদ্রের নিচের এই পর্বতের গোড়া থেকে চূড়া পর্যন্ত হিসাবে। যতদূর জানা গেছে, ১৮৭৩ সাল থেকে এই আগ্নেয়গিরিটি ৩৩ বার অগ্ন্যুৎপাত করেছে।

এত গেল পৃথিবীর হিসাব, আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি কোনটি? এটি হলো মাউন্ট অলিম্পাস। এটি বুধ গ্রহে অবস্থিত। এই আগ্নেয়গিরির আকৃতি বিস্ময়কর। জানা গেছে, মাউন্ট অলিম্পাস লম্বায় ২৭ কিলোমিটার আর প্রস্থে ৫২০ কিলোমিটার। পৃথিবীর আগ্নেয়গিরিগুলো নিয়ে একটা মজার জিনিস আছে, তা হলো- অগি্নবলয় (Ring of Fire)। প্রশান্ত মহাসাগরের চারপাশে অবস্থিত আগ্নেয়গিরিগুলোকেই বলে অগি্নবলয় (জরহম ড়ভ ঋরৎব)। কারণ হচ্ছে- প্রশান্ত মহাসাগরের চারপাশে এই আগ্নেয়গিরিগুলো বৃত্তের মতোই ঘিরে আছে। এ কারণেই একে বলে অগ্নিবলয়।

সৃষ্টির আদি থেকেই পৃথিবীতে কম-বেশি আগ্নেয়গিরির আগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীর বিবর্তনে আগ্নেয়গিরির অনেক ভূমিকা রয়েছে বলেও ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮১৫ সালে ইন্দোনিশিয়ায়। ওখানকার তামবোরা পর্বতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে শুধু না খেয়েই মারা গিয়েছিল ৯২ হাজার লোক। ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম ঘটনা ধরা হয় এটিকে। মজার ব্যাপার হলো এরপরের ঘটনাটিও ঘটেছে ইন্দোনেশিয়াতেই। এটি অবশ্য ঘটে ১৮৮৩ সালে ক্রাকাতাও পর্বতে। এই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে জলোচ্ছ্বাস বা সুনামিরও সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সুনামিতেই মারা গিয়েছিল ৩৬ হাজারেরও বেশি মানুষ। ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত 'পেলে' পর্বতে ১৯০২ সালে ঘটে যায় আরেকটি ভয়ঙ্কর অগ্ন্যুৎপাত। সেই অগ্ন্যুৎপাতের ছাইয়ের কারণে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। আর ইতালির ভিসুভিয়াস পর্বতের অগ্ন্যুৎপাতের লাভা প্রবাহ আর উত্তপ্ত কাদার প্রবাহে মারা গিয়েছিল ৩ হাজার ৫০০ জনের মতো। এটা অবশ্য অনেকদিন আগের কথা, সেই ১৬৩১ সালের।

সাম্প্রতিককালেও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছে। অতি সম্প্রতি আইসল্যান্ড আগ্নেয়গিরির ছাইভস্মের প্রভাবে আতঙ্ক ও বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আইসল্যান্ডের এজাফালাজোকুল পর্বতের অগ্ন্যুৎপাতে ভয়ঙ্কর আলোড়ন তোলে। ২০১০ সালের ২০ মার্চ এর ঘটনা। হঠাৎ করেই সেই আগ্নেয়গিরি থেকে ছাইভস্মের ইদগীরণ শুরু হয়। একটানা আগুন আর ছাইয়ের উদগীরণ চলে ২৩ মে পর্যন্ত। আর সেই আগুনে ছাইয়ের জন্য ছয় দিন ধরে ওই এলাকার ওপর দিয়ে সব উড়োজাহাজের চলাচলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় ৮০০ লোককে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছিল।

এরপর গত ২ জানুয়ারি, ২০১০ ফ্রান্সের পিটন দে লা ফোরনেইজ (Piton de la Fournaise) পর্বতে হয়ে গেল আরেকটা ছোটোখাটো অগ্ন্যুৎপাত। ১০ দিন স্থায়ী ছিল সেটা। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও আগ্নেয়গিরিতে পর্যটকের সংখ্যা কিন্তু বছরের পর বছর ধরে বেড়েই চলছে। অবশ্য আগ্নেয়গিরির আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও এর জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া জাপানের ফুকুটোকু-ওকানোবা (Fukutoku-Okanoba) ও কিরিশিমা (Kirishima), কঙ্গোর নায়ামুরাগিরা (Nyamuragira) আর কোস্টারিকার তুরিএলবা (Turrialba) প্রভৃতি আগ্নেয়গিরিতেও সাম্প্রতিককালে ছোট বড় অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছে। সব ঘটনাই এ বছরের অর্থাৎ ২০১০ সালের। এর মধ্যে ফুকুটোকু-ওকানোবা হচ্ছে সমুদ্রের নিচের একটি বিখ্যাত আগ্নেয়গিরি।

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচুর। ছাই, কাদা, গলিত পাথরের এসব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের উদগীরণ। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গ্যাসের নিঃসরণও আছে। যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড আরো অনেক ধরনের গ্যাস। এসব গ্যাস যখন বায়ুমণ্ডলে জমা হতে থাকে, তখন এদের সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের মেঘের পানি যুক্ত হয়ে তৈরি করে এসিড। এর কারণেই মূলত ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি হয়। এসিড বৃষ্টির ঝুঁকি ছাড়াও এইগ্যাসের রয়েছে নানা ক্ষতিকর প্রভাব। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এসব গ্যাস মারাত্মক প্রভাব। ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী এই গ্যাস আর আগ্নেয়গিরির ছাই। বিশেষ করে আগ্নেয়গিরির ছাই উড়োজাহাজ চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি করে। আবার আগ্নেয়গিরির সেই গলিত লাভার কথা ভাবলে তো গা শিউরে ওঠে। ঠিক বন্যার পানির মতো তেড়ে আসা ভয়াবহ তাপমাত্রার গলিত মাটি ও পাথরের স্রোত! তবে আশার কথা হলো এখন অগ্ন্যুৎপাতের খবর আগেই জানা যায়। কোনো আগ্নেয়গিরি হঠাৎ অস্থির হতে শুরু করলেই ওই এলাকার সবাইকে সচেতন করে দেওয়া হয়, যেন তারা সরে যায় খুব দ্রুত।

আগ্নেয়গিরি যে শুধু ক্ষতিই করে এমন নয়। অগ্ন্যুৎপাতের সময় যে ছাইটা বের হয় সেখানে কিন্তু অনেক ধরনের খনিজ পদার্থ থাকে। যখন সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যায়, মাটির গুণগত মান অনেক বেড়ে যায়। সেই মাটিতে ফসল উৎপাদনও হয় অনেক ভালো। আগুন মুখো পাহাড় বা আগ্নেয়গিরি ভয়ঙ্কর হলেও সুন্দর। আর সে জন্যেই ঝুঁকি থাকা স্বত্বেও সবাই ছুটে আসে এই চিরন্তন ভয়ঙ্কর সুন্দরের কাছে।
 এক নজরে..
-স্মিথ সোনিয়ান ইনস্টিটিউটের ভলকানোজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড বুক-এর তথ্যমতে, পৃথিবীতে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির সংখ্যা ১৫১১টি।
-বিশ্বের ৯০ শতাংশ জীবন্ত আগ্নেয়গিরির অবস্থান দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে। এ অঞ্চলে রয়েছে ১১০০- এর অধিক সক্রিয় বা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এত বেশি সংখ্যক আগ্নেয়গিরির অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলকে বলা হয় রিং অব ফায়ার বা অগি্নবলয়।

-ইতালির ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতই বিশ্বের সর্বপ্রথম আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। ৭৯ ঈসায়ীব্দে এ অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটে।

-উনিবিংশ শতকে বিশ্বে সবচেয়ে বিপর্যয়কর ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে ইন্দোনেশিয়ায়। ১৮১৫ সালে জাভার তামেবারা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে প্রায় ৯২ হাজার মানুষ নিহত হয়।

-সবচেয়ে উত্তপ্ত লাভা নির্গত হয় হাওয়াই দ্বীপের আগ্নেয়গিরি থেকে। লাভার উত্তাপ থাকে প্রায় ১১৭০ ডিগ্রি সেন্টিগেড।

-বিশ্বের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরি 'মনোলোয়'। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এটি অবস্থিত। প্রায় ৫১২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে মনোলোয়ার অবস্থান। আয়তন প্রায় ৪০ হাজার ঘনকিলোমিটার। মনোলোয়ায় সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। উল্লেখ্য, হাওয়াই "দ্বীপপুঞ্জ ২০টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত, যা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল।---বিশ্বের উচ্চতম আগ্নেয়গিরি হলো 'ওহোস ডেল সালাডো'। এটি চিলি ও আর্জেন্টিনা সীমান্তে অবস্থিত।

-বিশ্বের সর্ববৃহৎ আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ইন্দোনেশিয়ায় টোবা। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭৭৫ বর্গ কিলোমিটার।

-জাপানে প্রায় ২০০টি আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এর মধ্যে ৬০টিরও বেশি জীবন্ত।
রনক ইকরাম

0 comments:

Post a Comment