Saturday, September 18, 2010

ইয়ঙলুর ঘণ্টা

0 comments
চীনের তা চুং সু মন্দিরের প্রকাণ্ড ঘণ্টাটির আওয়াজ শোনা যায় ৩৭ মাইল দূর থেকেও। সম্রাট ইয়ঙলু এটি তৈরি করেন। ঘণ্টাটি তৈরির পিছনে রয়েছে একটি মর্মান্তিক গল্প। সম্রাট তার মন্দিরের বিরাট ঘণ্টা তৈরির ফরমায়েশ দিলেন শহরের সেরা কর্মকারকে। শর্ত একটাই ঘণ্টা হতে হবে প্রকাণ্ড এবং আওয়াজ হতে হবে খুব বেশি কিন্তু শ্রুতিমধুর। কয়েক মাস কাজ করে সে প্রকাণ্ড ঘণ্টাটি তৈরি করা হলো। কিন্তু সে ঘণ্টার আওয়াজ সম্রাটের পছন্দ হলো না। আবার নতুন ঘণ্টা তৈরির ফরমায়েশ দেওয়া হলো। ২/৩ মাস কষ্ট করে কর্মকার ঘণ্টাটি আবার তৈরি করলেন। কিন্তু ওই ঘণ্টার শব্দও সম্রাটের মন মতো হলো না।
কর্মকারের দু'বারের বিফলতায় সম্রাট ক্ষিপ্ত হলেন। আবার আদেশ দিলেন নতুন ঘণ্টা বানাতে। এবার যদি সম্রাটের নতুন ঘণ্টার শব্দ পছন্দ না হয় তা হলে কর্মকারের গর্দান যাবে। সম্রাটের এই আদেশ শুনে কর্মকার ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়িতে ফিরল। তার সব জ্ঞান দিয়ে তো সে কাজ করেছিল, তবুও হচ্ছে না কেন! সে তার ভুল কিছুতেই বুঝতে পারল না। শহরের এক বিখ্যাত জ্যোতিষীকে কর্মকার তার বাড়িতে ডেকে আনল। জ্যোতিষী সব শুনে বলে দিলেন মন্দিরের দেবতা তার উপর রুষ্ট হয়েছেন, তাই তাকে খুশি করতে হলে একটি নিষ্পাপ প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে। একথা শুনে কর্মকার আতকে উঠল। সে ঠিক করল নিজের সকল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে পুনরায় ঘণ্টা তৈরি করবে। এতে যদি তার নিজের প্রাণ যায় তবে তার কোনো আপত্তি নেই। তবে সে কোনো শিশুর প্রাণ নিতে পারবে না। কর্মকারের বারো বছরের একটি মেয়ে ছিল। তার নাম 'মাও-আই'। সে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনল। তার বাবার বিপদ সে আর সহ্য করতে পারছিল না। তাই সে ঠিক করল নিজের জীবন উৎসর্গ করে তার বাবাকে বাঁচাবে। কিন্তু কর্মকার তার মেয়ের কঠিন সিদ্ধান্তের কথা কোনোক্রমেই জানাতে পারেনি। কর্মকার তার জীবনের সব অভিজ্ঞতা ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে বিশাল চুলি্লতে লোহা গরম করছিল। শেষবারের মতো ঘণ্টা তৈরি করতে লাল গনগনে লোহা টগবগ করে ফুটতে থাকল। হঠাৎ কোথা থেকে যেন ছুটে এসে তার ছোট্ট মেয়ে 'মাও-আই' ঝাঁপিয়ে পড়ল চুলি্লর পাতিলের উপরে। চোখের পলকে তার শরীর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল গলিত লোহার মধ্যে। ঘটনাটি যতই মর্মান্তিক হোক না কেন কর্মকার তার মেয়ের দেহমিশ্রিত লোহা দিয়েই চোখের জলে বুক ভাসিয়ে একটি সুন্দর ঘণ্টা তৈরি করল।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সত্যি সত্যি এই ঘণ্টার আওয়াজ হলো অনেক বেশি। এই সুমধুর শব্দের ঘণ্টা তৈরির জন্য সম্রাট কর্মকারকে পুরস্কৃত করলেন।

বহু বছর পরে এ বিস্ময়কর ঘণ্টার ধাতব গুণাগুণ পরীক্ষা করতে গিয়ে বের হয়ে এলো আসল তথ্য। আগের দু'বার ধাতু মিশ্রণে ত্রুটি থাকায় ঘণ্টা সঠিকভাবে তৈরি হয়নি। কর্মকার তার পূর্বের বানানো ঘণ্টাগুলোতে কাঁসা, সোনা, রূপা, তামা ইত্যাদি মিশ্রণ ব্যবহার করেছিল। কিন্তু ধাতুর আওয়াজ জোরালো করতে চাই ফসফরাস, যা তাতে ছিল না। তৃতীয়বার ওইসব ধাতুর মিশ্রণের সঙ্গে 'মাও-আইয়ের' দেহের ফসফরাস মিশে গিয়ে উৎকৃষ্ট মিশ্রণের সৃষ্টিতে ঘণ্টার আওয়াজ জোরালো হলো। কারণ মানবদেহে প্রচুর পরিমাণে ফসফরাস আছে। তাই শেষবারে ঘণ্টার আওয়াজ হলো অনেক জোরালো। সেই 'মাও-আইয়ের' দেহ মিশ্রিত ঘণ্টাটি এখনো চীন দেশে আছে। চীন দেশের মানুষ আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে সেই ছোট্ট মেয়েটির ত্যাগের কথা, যা ইতিহাসের পাতায় আজোও অম্লান হয়ে আছে।

শামছুল হক রাসেল

0 comments:

Post a Comment