Tuesday, September 28, 2010

অজন্তা

0 comments
অজন্তা নামটির সঙ্গে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে একটি সুন্দর নারীর অবয়ব। একটু সাহিত্যিকমনা যারা, তারা তাদের আদরের মেয়েটির নাম খুঁজতে গিয়ে যে নামগুলো বাছাই করেন তাদের মধ্যে অজন্তা, ইলোরা বা কোনো নক্ষত্র অথবা নদীর নাম থাকে। অধিকাংশরাই এই নাম রাখেন নামের সৌন্দর্যের কারণে। খুব সহজেই এই নামটি আমরা আমাদের প্রিয় মানুষের জন্য নির্বাচন করে থাকি। অথচ এই অজন্তা তৈরিতে রয়েছে হাজারো মানুষের রক্ত এবং ঘাম। কি এই অজান্তা? কেন এবং কারা এর শ্রষ্টা।

মূলত অজান্তা একটি নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের পুরনো একটি সমৃদ্ধ চিত্রশিল্পের ইতিহাস। হায়দ্রাবাদের খান্দেশ জেলায় এই অজান্তা অবস্থিত। অজন্তা ইন্দ্রাদি পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত একটি গুহা। বাগোড়া নদী এসে এই অঞ্চলে বাঁক নিয়েছে। ফলে পাহাড়ের আকার এখানে অর্ধচন্দ্রের মতো ধারণ করেছে। পাহাড়ের এই অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাদদেশে বেশ কয়েকটি গুহা রয়েছে। গুহার সংখ্যা ৩০টি। সবগুলো গুহা একত্রিত করলে এর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৬০০ গজ। গুহাগুলোর ছাদ ৩৫ ফুট থেকে ১০০ ফুট উঁচু। অজান্তার এই গুহাগুলো প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়নি। পাথর কেটে কেটে এগুলো তৈরি করা হয়েছে। চিত্র ছাড়াও এখানে বেশকিছু ভাস্কর্য রয়েছে। অজান্তা গুহাচিত্রের বিষয়বস্তু ছিল বুদ্ধের জীবনী এবং জাতকের গল্প। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘসময় অজন্তার গুহাগুলো নির্মিত হয়। ৩০টি গুহার মধ্যে ২৫টি ছিল উপসনাগৃহ এবং চৈত্য। অজান্তার গুহাগুলোতে চিত্রাঙ্কন শুরু হয় ৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই চিত্রাঙ্কন অব্যাহত ছিল। অজান্তার ১৩ নং গুহাতে সবচেয়ে প্রাচীন চিত্র পাওয়া যায়। গুহাগুলোতে বৌদ্ধ শ্রমণরা বসবাস করত এবং ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় চিত্র অঙ্কন করত। কোনো এক সময় গুহা নির্মাণকারী এবং চিত্র অঙ্কনকারী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। কি কারণে তারা এই গুহাবাস ত্যাগ করেছিলেন তা জানা যায় না। এর পর হাজার বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় এটি মানুষের অগোচরে থেকে যায়। অবশেষে অজান্তার রহস্য আধুনিক মানুষের কাছে উন্মোচিত হয় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সৈন্যরা শিবির স্থাপন করতে গিয়ে অজান্তার স্থাপত্য ও শিল্পকলার সন্ধান পায়। তাদের এই আবিষ্কার প্রথমে তেমন প্রচার পায়নি। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে একটি অনুসন্ধানী দল আসে অজন্তায়, যারা তাদের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। সবশেষে শিল্প বিশেষজ্ঞ মি.ফার্গুসন অজান্তা পর্যবেক্ষণ করে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।

অজান্তার গুহাচিত্রের বিষয়বস্তুর অধিকাংশই জাতকের গল্প। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাকে ঘিরে যেসব কল্পিত কাহিনী তৈরি হয় তাই হচ্ছে জাতকের গল্প। এগুলো ছাড়াও গুহাচিত্র হিসেবে আছে বুদ্ধের জীবনী, ধর্মের প্রতীক চিহ্ন এবং দৈনন্দিন জীবনের নানাদিক। এ ছাড়াও আছে কতগুলো প্রস্তরমূর্তি এবং সামান্য কিছু অন্য বিষয়ের ছবি। ১ নং গুহাচিত্রে অধিকাংশই জাতকের গল্প। এ ছাড়াও আছে কতগুলো প্রস্তরমূর্তি। পশ্চিম দিকের দেয়ালে আছে ষাঁড়ের লড়াইয়ের চিত্র। তাছাড়াও আছে দলবদ্ধ হাতি, টিয়াপাখি,ষাঁড় এবং বানরের ছবি। অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি আছে পূর্বদিকের প্রাচীরে। অজান্তায় কিছু নারীচিত্রও পাওয়া গেছে। এ সব ছাড়াও কিছু ভাস্কর্য পাওয়া যায় অজন্তার দেওয়ালে। পরবর্তীকালে চিত্রে পারস্যের রাজদরবারের ছবি আঁকা হয়েছে। চালুক্য রাজ পুলকেশীর চিত্রও এখানে আঁকা আছে। দ্বিতীয় গুহার চিত্রগুলোতে জাতকের কাহিনী থেকে নেওয়া বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ক ছবি আঁকা রয়েছে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বুদ্ধের প্রতিকৃতি। রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন চিত্র। পশুপাখির ছবি দেখা যায় দেয়াল চিত্রে। নবম গুহাটি ছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের উপসনাগৃহ। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এখানে চিত্রসমূহ ফুটে তোলা হয়েছে। ১০ নং প্রাচীন গুহাটির অধিকাংশ চিত্রই প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। গৌতম বুদ্ধের জীবনের প্রথম দিকের কিছু ঘটনার চিত্র আছে ১৬ নং গুহাতে। মৃত্যুপথযাত্রী রাজকুমারীর নামে একটি চিত্র সেখানে পাওয়া যায়। শিল্প সৌন্দর্যেও বিচারে এই চিত্রটি বিস্ময়কর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। লোকালয় থেকে দূরে বসে সবাইর অজান্তে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা পার্থিব জীবনের বিষয়বস্তু নিয়ে আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে যে ছবিগুলো এঁকে গেছেন তা এখনো আমাদের কাছে বিস্ময় এবং রহস্য রয়ে গেছে।



এস এম নাজমুল হক

0 comments:

Post a Comment