Tuesday, September 28, 2010

ভাসুবিহার

0 comments
বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থান গড় থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব কোণে ভাসুবিহারের অবস্থান। তিন দিকে ফসলি মাঠ আর এক পাশে গ্রামে ঘেরা ভাসুবিহার স্থানীয়দের কাছে নরপতির ধাপ নামে পরিচিত। উঁচু টিলা আকৃতির এই ধাপটি এক সময় ছিল বৌদ্ধ বিহার। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩৯-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে এই বৌদ্ধ বিহার পরিদর্শন করেন। তিনি তার বিবরণে উল্লেখ করেছেন, এই বৌদ্ধ বিহারে তিনি ৭০০ ভিক্ষুকে পড়ালেখা করতে দেখেছেন। হিউয়েন সাংয়ের বিবরণের ওপর ভিত্তি করে স্যার আলেকজান্ডার কানিং হাম (১৮৭৯) বর্তমানের ভাসুবিহারকে হিউয়েন সাংয়ের দেখা বৌদ্ধ বিহার হিসেবে শনাক্ত করেন।

বিহারের আশপাশে গড়ে ওঠা গ্রামের মানুষগুলো জানিয়েছে, দুই হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা ওই জনপদ এখন টিকে আছে কালের সাক্ষী হিসাবে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এখানে ভ্রমণে আসেন। বিভিন্ন বেসরকারি ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা সফরে এসে খুটে খুটে খোঁজার চেষ্টা করে সে সময়ের কথা। বিহারের অপূর্ব নির্মাণশৈলী যে কাউকে তাক লাগিয়ে দেবে। পোড়া মাটি (ইট) আর সুরকির কি এমন শক্তি ছিল যে দুই থেকে আড়াই বছর পরেও চিহ্ন রেখে গেছে। তাদের কি এমন নির্মাণ কৌশল ছিল? এমন প্রশ্ন মনের মধ্যে গেঁথে যাবে আপনারও। বিহারের ধাপে ধাপে বেশ কিছু কক্ষ রয়েছে। ৫ থেকে ৭ ফুটের চওড়া ভিত ও কক্ষ দেখলে বোঝা যায় এখানে একসময় অতি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উন্নত ও নিয়মনীতির বিষয়গুলো ছিল কঠোর।

ধারণা করা হয় বিহারের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত কক্ষগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষু পড়ালেখা করত এবং আবাসিক হিসেবে ব্যবহার করত। বিহারের ঠিক দক্ষিণ অংশে ভিক্ষুদের উপাসনালয়ের জন্য একটি মন্দির বা এ জাতীয় কিছু নির্মাণ করা হয়েছিল। কালের বিবর্তনে ভাসুবিহার এখন শুধু ধ্বংস স্তূপ।

ঐতিহাসিকদের বিবরণের ওপর ভিত্তি করেই এই বৌদ্ধ বিহারে একাধিকবার প্রত্নতাত্তি্বক খনন পরিচালিত হয়।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ এবং ১৯৮৪ সালে পরিচালিত প্রত্নতাত্তিক খননের ফলে ভাসুবিহার প্রত্নস্থলে পাশাপাশি অবস্থিত দু'টি সংঘারাম বা বিহার ও একটি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল। যা দশম থেকে একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত।

২০০৮ সালের ২৪ নভেম্বর এখানে আবারো খনন শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। সর্বশেষ এই খননকালে অপর একটি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয় যা দশম থেকে একাদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এ বৌদ্ধ মন্দিরের ভিত্তিভাগের ২ মিটার নিচে আরো একটি স্থাপত্য কাঠামোর (ইটের দেয়াল) নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে যা প্রায় দেড় হাজার আগে নির্মিত হয়েছিল। এছাড়াও একই সময়ে নির্মিত বৌদ্ধ বিহারের নিচে অর্থাৎ এই কাঠামো দ্বারা আবৃত একটি বৌদ্ধ ভিক্ষু কক্ষের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রথম প্রাচীন কোনো বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু কক্ষের দেয়াল মেঝে হতে ১৭ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত টিকে আছে। সর্বশেষ এই খনন থেকেই প্রমাণ মিলেছে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর দেখা সেই বৌদ্ধ ভিক্ষু কক্ষের।

সর্বশেষ খননকালে বেশ কিছু প্রাচীনকালের পোড়া মাটির সিলিং ও এনবিপিডবিউ পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত সিলিং-এর ওপর উৎকীর্ণ লিপির ধরন (ব্রাহ্মী হরফ) এবং এনবিপিডবি্লউ প্রাপ্তিতে অনুমান করা হচ্ছে যে এখানে বসতি আরো বহু আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব যুগে আরম্ভ হয়েছিল। অর্থাৎ সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে প্রায় ২ হাজার বছর আগে এখানে সমৃদ্ধ বসতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন এর নিরাপত্তার কোনো বিধান নেই। কত শত বছর পরে আছে এভাবেই। নিরাপত্তার বিধান না থাকায় এর মাটির নিচে চাপা পড়া মূল্যবান জিনিসপত্র লুণ্ঠন যে হয়নি তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। উদ্যোগ নিলে আধুনিক পর্যটন স্পট হয়ে উঠতে পারে সারা দেশসহ এ অঞ্চলের মানুষের জন্য। সরকারিভাবে বিহারের সংরক্ষণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। মহাস্থানগড় যেমন আজো হয়ে উঠেনি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র তেমনি ভাসুবিহারও সম্ভাবনাময় হয়েও থেকে গেছে অযত্ন-অবহেলায়। এভাবেই কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর তারপর হাজার বছর।

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

0 comments:

Post a Comment