Monday, September 20, 2010

কার্জন হল

0 comments
ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয় কার্জন হল। এর নির্মাণশৈলীতে ইউরোপ ও মুঘল স্থাপত্যরীতির দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণ রয়েছে। এই হলকে ঘিরে অনেক ইতিহাস ও ঘটনার জš§ হয়েছে।

বৃটিশ-ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের নামানুসারে নির্মিত হয়েছিল কার্জন হল। ১৯০৪ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি লর্ড কার্জন এ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রথমে এটি টাউনহল হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। সেসময় বড়লাট বাহাদুর (কার্জন) রাষ্ট্রীয় সফরে পূর্ববঙ্গে এলে মূলত তার সফরকে স্মরণীয় করে রাখতেই তার নামে নির্মাণ করা হয়েছিল এ ভবন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা হয়ে ওঠে নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী। তখন প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলার জন্য বর্তমান রমনা এলাকায় যেসব ইমারত নির্মিত হয়েছিল, কার্জন হল ছিল তারমধ্যে অন্যতম। তবে ইতিহাসবিদ শরীফউদ্দীন আহমেদের ভাষ্যে, প্রথমে টাউনহল হিসেবে কার্জন হল নির্মাণের ধারণাটি ভুল। তার মতে, মূলত ঢাকা কলেজের পাঠাগার হিসেবে এ হল নির্মিত হয়েছিল। এ পাঠাগার নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেছিলেন তৎকালীন ভাওয়াল রাজকুমার রনেন্দ্র নারায়ণ। উল্লেখ্য, কার্জন হল নির্মাণকালে এর আশপাশ এলাকা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। এ হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে এসে লর্ড কার্জন তার ভাষণে বলেন, শহরের মধ্যভাগে কলেজের উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করাই অভিপ্রেত ছিল। কিন্তু উপযুক্ত স্থান সংগ্রহ করিতে এত ব্যয় আবশ্যক যে, কখনও এ উদ্দেশ্য কার্যে পরিণত হইতো কিনা সন্দেহ। উদ্দিষ্ট কার্যের জন্য এখানে প্রচুর পরিমাণে ভূমি সংগৃহীত হইয়াছে। বর্তমান সময়ে স্থানটি জঙ্গলময় দেখাইতেছে বটে, কিন্তু এখানে কলেজগৃহ এবং ছাত্রাবাসাদি নির্মিত হইলে এই সকল দূরীভূত হইবে। এখানে হোস্টেল, ক্রীড়াভূমি এবং অধ্যাপকবর্গের নিকেতন নির্মিত হইবে। কুমার রনেন্দ্র নারায়ণ প্রয়োজনীয় গৃহনির্মাণের ব্যয় প্রদান করিয়াছেন, লর্ড কার্জনের এ ভাষণ থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, কার্জন হল প্রথমে টাউন হল হিসেবে নির্মিত হয়নি। এটি নির্মিত হয়েছিলো ঢাকা কলেজের পাঠাগার হিসেবে। তবে এ ভবনে কলেজের পাঠ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্লাসও অনুষ্ঠিত হত। আবার, কারো কারো মতে ১৯২১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ার পর ভবনটি ঢাকা কলেজের পাঠাগার হিসেবে ব্যবহƒত হতে থাকে।

পরবর্তী সময়ে (১৯২১ সালে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানভবন হিসেবে ব্যবহƒত হতে শুরু করে। বর্তমানেও এ হল ঢাবির বিজ্ঞানভবন হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। বায়ো-কেমেস্ট্রি, ফার্মাসি, মাইক্রোবায়োলজি, সয়েল সাইন্স, ফিজিক্স, অ্যাপলাইড ফিজিক্সসহ বিজ্ঞান অনুষদের প্রায় সবক’টি বিভাগই এ ভবনে অবস্থিত। তবে কোনো কোনো বিভাগের ক্লাস বাইরে অনুষ্ঠিত হয়। নির্মাণকালীন এর মূল ভবনে বর্তমানে অবস্থিত পদার্থ ও মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ। বিভিন্ন সময়ে মূল ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে একই আদলে নতুন

নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন কারুকার্যে গড়ে তোলা দ্বিতল এ ভবনটিতে একটি বিশাল কেন্দ্রীয় হল রয়েছে। সম্পূর্ণ ভবনটি লাল ইটে নির্মিত। মূল ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের সংযোজিত কাঠামোটি অসংখ্য কক্ষ সমৃদ্ধ এবং চারপাশ বারান্দা দিয়ে ঘেরা। এ ভবন নির্মাণে দেখা যায় ইউরোপ ও মুঘল স্থাপত্যরীতির দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণ। স্থাপত্য রীতির এ সংমিশ্রণ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় অভিশিপ্ত উত্তরদিকের সম্মুখভাগের অশ্ব-খুরাকৃতি ও খাঁজকাটা খিলানের মাঝে। এখানে ঐতিহ্যিক শিল্পের সাথে আধুনিক কারিগরিবিদ্যার মিলন লক্ষ্য করা যায়। এর গঠন কাঠামোতে রয়েছে মুঘল আমলের স্থাপ্যরীতির ছাপ, যা খিলান ও গম্বুজে বিধৃত। ভবনটির নির্মাণ কৌশলে ফুটে ওঠে পাশ্চাত্য থেকে ইসলামি স্থাপত্য জগতে প্রবেশের চেষ্টা। ১৮৫৭ সালে সিপাহীবিদ্রোহের পর প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা পরিহার করে ভারতকে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনাধীনে নেয়ার পর মুঘল যোগসূত্র রক্ষা করে এর বৈধতা প্রদানের প্রয়াস এতে পরিলক্ষিত হয়। কার্জন হল নির্মাণে লাল রঙ ব্যবহƒত হয়েছিল মুঘল আমলের লাল বেলে পাথরের পরিবর্তে। এর অলংকৃত বন্ধনী গভীর ছাইচ, প্যাভিলিয়ান, বিশেষ করে মাঝের অংশগুলো নির্মিত হয়েছিল সম্রাট আকবরের (১৫৭০-১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ) রাজধানী প্রাসাদসমৃদ্ধ নগর-দুর্গ ফতেহপুর সিক্রির ছোট কিন্তু বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দীউয়ান-ই খাসের অনুসরণে। ইংরেজদের চোখে মুঘল শাসকদের মধ্যে সম্রাট আকবরই ছিলেন সবচেয়ে বিজ্ঞ ও সর্বাধিক সহিষ্ণু। ফলে, ব্রিটিশ বেনিয়ারা রাষ্ট্র পরিচালনায় আকবরের আমলের বিভিন্ন রীতিনীতি অনুসরণে সচেষ্ট ছিল। তারা দেখাতে চেয়েছিল, ভারতে ঔপনিবেশিক ইংরেজদের ভূমিকা আকবরের অনুরূপ। তবে বৃটিশদের এ অগ্রহণযোগ্য ব্যর্থ প্রচেষ্টা মুসলিম সমাজে দ্রোহের আগুনে ঠিক তেল ঢালার অবস্থা হয়। অধ্যাপক আহমদ হাসান দানীর মতে, কার্জন হল নির্মাণে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রুচি প্রাধান্য পেয়েছে। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছিল ইসলামী স্থাপত্যের উপাদান সমূহ, তবে ইসলামি স্থাপত্যের আকৃতি এখানে অনুপস্থিত। ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয় কার্জন হল।

আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে কার্জন হল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ১৯৪৮ সালে এ ভবনেই পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা। তারা জিন্নাহর উপস্থিতিতে সেøাগান তুলেছিল। শেষমেষ অদম্য দামাল ছেলেরা বাংলাকে কিনেছিল রক্ত সাগরের বিনিময়ে। আবার সেদিনের মতো জেগে ওঠো নিথর বাংলাদেশ। বরকত, জব্বারের রক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে এগিয়ে চল আগামী ও সুন্দরের পথে।
০০ আল মেহেদী ০০ 

0 comments:

Post a Comment