Saturday, September 25, 2010

অসুস্থ হলে মৃত্যুই পরিণতি

0 comments
০০ ইয়াসমিন পিউ, তিস্তা চর থেকে ফিরে

চরের অভাবী মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা অধিকার নয়, যেন বিলাসিতা। অপুষ্টি আর রোগে জীর্ণ-শীর্ণ মানুষগুলোর কাছে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যেন সৌভাগ্যের বিষয়। অল্প-স্বল্প সর্দি-জ্বর কিংবা পেটের পীড়ার জন্য এরা কখনো ডাক্তারের কাছে যান না। অসুখে একেবারে শয্যাগত হলেই কেবল ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবেন। আর নারীদের প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিলে মৃত্যুই যেন তাদের একমাত্র পরিণতি।
চরের মানুষগুলোর জন্য চিকিৎসা, হাসপাতাল, ক্লিনিক তো দূরের কথা, একজন এমবিবিএস ডাক্তারও নেই। চর জয়রামওঝা থেকে গঙ্গাচড়া উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে ১৩ কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়, আর লালমনিরহাট কালিগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে চরবাসীকে ১৫ থেকে ১৬ কিলোমিটার যেতে হয়। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য এম্বুলেন্স তো দূরের কথা, সেখানে কোন রিকশা-ভ্যান চলে না। যার কারণে চরে কোন মানুষ গুরুতর অসুস্থ হলে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুই যেন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।

চরে কোন মানুষ অল্প অসুস্থ হলে হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভাবেন না। কারণ অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে আনা অত্যন্ত ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। চরে রিকশা-ভ্যান না থাকায় রোগীকে একটি চৌকি বা বেঞ্চিতে শুইয়ে দিয়ে সেই চৌকির পাশে বাঁশ বেঁধে ঘাড়ে করে বেয়ে নদীর পাড়ে আনতে হয়। নদীর ঘাটে জরুরি বলে কোন কথা নেই, নৌকার নির্ধারিত সময়ই অসুস্থ রোগীকেও নদী পার করে আনতে হয়। আর এর জন্য টাকাও গুনতে হয় অনেক।

চরাঞ্চলে জš§নিরোধক সামগ্রী ব্যবহার নেই বলেই অপরিকল্পিতভাবে বাড়ছে চরের জনসংখ্যা। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরিবেশদূষণ, হচ্ছে স্বাস্থ্যহানী। স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা নেই। তারা খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করে। বৃষ্টির পানিতে সেসব ধুইয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে পুকুরে। সেই পানিতেই চলছে চরবাসীর গৃহস্থালির কাজ। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাসের ফলে শরীরে বাসা বাঁধছে খোশপাঁচড়াসহ নানা ব্যাধি।

চল্লিশার চরের গেদু মিয়া (৫৫)। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে প্রহর গুনছেন মৃত্যুর। জানতে চাইলাম, ডাক্তার দেখিয়েছেন? জবাবে গেদু মিয়া বলেন, বয়স শ্যাষ, মরার সময় হইছে, এখন আর কি ডাক্তার দেখামো! পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা গেদু মিয়ার ছেলে বলেন, এর আগে কৌবরাজের কাছে গেছিল, কৌবরাজ কইছে হাঁপানির টান বেশি, এই রুগীকে বাদুড়ের গোস্ত খাওয়াইতে হইবে। চর জয়রামওঝার বাসিন্দা তোফাজ্জল মিয়ার জন্ডিস ধরা পড়েছে মাসখানেক হলো। চরে ডাক্তার না থাকায় তিনি কবিরাজকে দেখিয়েছেন, তিনি কি যেন একটা গাছের ডালের মালা বানিয়ে তোফাজ্জল মিয়ার মাথার উপরে দিয়ে দিয়েছেন। সেই মালা ধীরে ধীরে বড় হয়ে মাথা থেকে গড়িয়ে শরীর বেয়ে পা দিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তাদের ধারণা, এভাবেই জন্ডিস ভালো হয়ে যায়।

আরেকজন আশেক আলী জানান, তার মায়ের জন্ডিস হয়েছিল। কবিরাজ তাকেও ঐ মালা চিকিৎসা দিয়েছিলেন, তাতে জন্ডিস ভালো হয়নি। এরপর তার মায়ের পিঠে কাঁসার বাসন লাগিয়ে জন্ডিস ঝাড়া হয়েছিল, তারপরে জন্ডিস ভালো হয়েছে। এর মাসখানেক পর আশেক আলীর মা মারা গেছেন। আশেক আলীর চিকিৎসার বিস্তারিত শুনে বোঝার বাকী রইলো না, এসব কবিরাজি চিকিৎসায় জন্ডিস ভালো হয়নি; বরং সে অসুখেই হয়তো তার মা মারা গেছেন। অথচ অশিক্ষিত এই মানুষগুলো সে বিষয়ে কিছুই জানে না।

চরের নারী স্বাস্থ্যের অবস্থা আরো করুণ। কালিগঞ্জ উপজেলার দুর্গম চর শৈলমারীতে প্রবেশ করতেই কানে ভেসে আসে পঞ্চাশোর্ধ্ব আমেনা বেগমের করুণ কান্না। জানা যায়, মাত্র দুইদিন আগেই আমেনা বেগমের কিশোরী কন্যা সন্তান জš§ দিতে গিয়ে মারা গেছে। আমেনা বেগমের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম কিভাবে মারা গেছে মেয়ে? আমেনা বলেন, ‘সানঝের (সন্ধ্যা) বেলা মেয়ের পেটের বিষ ওঠছে, বাচ্চা হইতে সময় নাগতেছিল বেশি, পোয়াতি মেয়ের অস্তির অবস্থা। একঘন্টা বাদে বাচ্চা হইলো; কিন্তু ফুল পড়ছিল না, দাই হাত দিয়া টানিয়া ফুল বাইর করলো আর মেয়ে হামার কইলজা গেল, কইলজা গেল করি ঝাপাতে ঝাপাতে চকির তলে জায়া জিউ (জীবন) ছাড়ি দিল। অর্থাৎ মারা গেল। এর ঘন্টাখানেকের মাথায় ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতকটিও মারা যায়।’

এমনি আমেনা বেগমের মতো চরের সন্তান হারা ও প্রসূতি মাতাদের আহাজারিতে চরের বাতাস ভারি হয়ে উঠে। কুসংস্কারসম্পন্ন এসব মানুষ মনে করে, পুরুষ ডাক্তারের কাছে প্রসবকালীন সময়ে নারীরা গেলে তাদের প্রসবকালীন দুর্ভোগ আরো বাড়ে। পরপুরুষের কাছে যাওয়ায় এটা ঈশ্বরের শাস্তি।

সরেজমিন চর অঞ্চলের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গঙ্গাচড়া, লালমনিরহাট চরের মানুষগুলোর অবস্থা একই রকম। চর কাশিরামে দেখা যায়, ছোট ছোট শিশুদের হাতে-পায়ে চুলকানী, ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা, কাশি এসব তাদের নিত্যদিনের অসুখ। বয়স্ক লোকের পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, হাঁটুতে ব্যথা এসব লেগেই থাকে। নারীদের কোমরে ব্যথা, মাথা ঘোরা। অপুষ্ট মায়ের জš§ দেয়া অপুষ্টির শিকার শিশুগুলোর অবস্থা দেখলে তাদের দুরবস্থার প্রমাণ মেলে। ছোট্ট ছোট্ট ঘরে ধুলোবালি মাখা খড়ের বিছানায় গাদাগাদি করে বেড়ে উঠা। ডায়রিয়া, নিমোনিয়া, পেটভর্তি কৃমি নিয়ে মাথামোটা পেটফোলা শিশুগুলোর বড়বড় চোখের অসহায় চাহনী বলে দেয় ওরা খুব কষ্টে আছে।

চারদিক নদী দিয়ে ঘেরা চল্লিশার চরবাসীর অভিযোগ, তাদের ভোটে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হলেও সংসদ সদস্য তো দূরের কথা চেয়ারম্যানরাই তাদের কোনো খোঁজ-খবর রাখে না। চরে কোন পুলিশফাঁড়িও নেই। তাই বিচারের বিষয়ে তারা গ্রাম্য সালিশের ওপর নির্ভরশীল। এমনি অযতœ আর অবহেলায় রয়েছে গঙ্গাচড়া, লালমনিরহাট ও হাতিবান্ধা চর এলাকার মানুষগুলো।

0 comments:

Post a Comment