Wednesday, September 22, 2010

টেলিপ্যাথি

0 comments
আপনি আপনার নতুন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছেন। হুট করেই বন্ধুটি এমন কিছু কথা বলে বসলো যা কখনো আপনি তাকে জানাননি। কথাগুলো কিন্তু মিথ্যে নয়। এই কথাগুলো আপনার মনের ভেতর ছিল। কিন্তু আপনার বন্ধু সে কথা জানলো কী করে? মনের কথা জানা বা অনুমান করার এই অদ্ভুত ক্ষমতাকেই টেলিপ্যাথি বলে। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট। নিজেদের অদ্ভুত ক্ষমতাবলে বুঝে নিতে পারে পাশের মানুষটির মানসিক অবস্থা। বলে দিতে পারে তার না বলা কথা। আবার কেউ কেউ নিজের চিন্তা-ভাবনা মুহূর্তেই ঢুকিয়ে দিতে পারে অন্যের মনে। তারা দেখতে পারে মানুষের আত্মাও! এরকম বিষয় নিয়েই আলোচনা করে প্যারা সাইকোলজি।

এটি সাইকোলজির একটি মজার শাখা। এখানে মানুষের অদ্ভুত সব ক্ষমতা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এমনই এক অদ্ভুত ক্ষমতা হলো টেলিপ্যাথি। টেলিপ্যাথি বলতে আসলে মানুষের অস্বাভাবিক বা অতি ইন্দ্রীয় যোগাযোগকে বুঝানো হয়। বলা চলে টেলিপ্যাথি হচ্ছে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারা। এরকম বিষয়গুলো আলোচিত হয় প্যারা সাইকোলজিতে। জার্মান সাইকোলোজিস্ট ম্যাক্স দেসোর (১৮৬৭-১৯৪৭) সর্বপ্রথম সাইকোলজির এই শাখাটিকে সংজ্ঞায়িত করেন। আর ফ্রেডরিক ডবি্লউএস মেয়ার ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো টেলিপ্যাথির সংজ্ঞায়ন করেন।

প্যারা সাইকোলজিতে অলৌকিক সব ঘটনা নিয়ে পর্যালোচনা করা হলেও এর সবই পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত। মানুষের মনের কোন ভুল বা ভ্রান্ত ধারণাগুলো কখনোই প্যারা সাইকোলজির বিষয়ভুক্ত হয় না। প্যারা সাইকোলজিস্টরা কিছু বিষয় নিয়ে তাদের বিশ্লেষণ করে থাকেন, যার মধ্যে পড়ে টেলিপ্যাথি, প্রি-রিকগনিশন, টেলিকিনসিস বা সাইকোকিনসিস, সাইকোমেট্রি, মৃত্যুস্পর্শ, বাইলোকেশন প্রভৃতি।

আসলেই কি এমন কিছু মানুষ আছে যারা প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট, যারা সত্যিই অন্যের আত্মা দেখতে পারে; বলতে পারে অন্যের মনের কথা। কিংবা নিমিষেই বদলে দিতে পারে অন্যের চিন্তা? সত্যিই কী টেলিপ্যাথির কোন অস্তিত্ব আছে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা কঠিন নয়। কেননা খুব কাঠখোট্টা বিজ্ঞানীও টেলিপ্যাথিকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন না। কিন্তু প্যারাসাইকোলজির অন্যগুলো এতোটা গুরুত্ব পায় না যতোটা পায় টেলিপ্যাথি। কারণ একটাই। ভালো মতো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমরা আমাদের জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে এরকম কিছু না কিছু ঘটনার প্রমাণ রয়েছে। যেমন ধরুন আপনি কোনো এক বন্ধুর কথা! গভীরভাবে চিন্তা করছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে আপনার বন্ধুটি আপনার বাসায় এসে হাজির। এসব বিষয়কে সাধারণত আমরা কাকতালীয় ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে যাই। তবে সবই কাকতালীয় নয়। কারণ এটি আসলে আমাদের মস্তিষ্কের এক অতীন্দ্রিয় সংবেদনশীলতা, যেটি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু আমরা চাইলেও সেখানে প্রবেশ করতে পারি না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অন্যদের মনোজগতে ভ্রমণ করতে পারে এমন লোকদের নিয়ে কিছু পরীক্ষা চালিয়েছিল তিন দ্য গ্রেট সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং ব্রিটেন। মজার ব্যাপার হলো তার চমকপ্রদ ফলাফলও পাওয়া গিয়েছিল। সে সময় টেলিপ্যাথি মিলিটারি ইন্টিলিজেন্সে একটি বিশেষ আসন করে নিয়েছিল এবং এর ধারকদের বলা হতো 'সাই এজেন্ট'। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা টেলিপ্যাথিকে রিমোট সেন্সিং বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সে যাই হোক, এই এজেন্টরা তাদের মনটাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এবং বস্তু সম্পর্কে তথ্য দিতেন।

সময়টা ১৯৪০ সাল, এরকমই এক ক্ষমতাধর টেলিপ্যাথ উলফ ম্যাসিং জোসেফ স্ট্যালিনের সুনজরে পড়লেন। উলফ ম্যাসিং এর মজার কিছু ঘটনা ছিল। যেগুলোতে তার অতি ইন্দ্রীয় ক্ষমতার অহরহ প্রমাণ ছিল।

এই প্রমাণগুলোকেই মূলত টেলিপ্যাথির প্রতি সরকারি আকর্ষণের সূত্রপাত ধরা হয়। পশ্চিমা বিশ্বও টেলিপ্যাথি নিয়ে নাড়াচাড়ায় পিছিয়ে ছিল না। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে এসজি সোয়াল (১৮৮৯-১৯৭৯) নামের ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের এক গণিতের প্রফেসর ১ লাখ মানুষের মধ্য থেকে ১৬০ জনকে নিয়ে টেলিপ্যাথি টেস্ট করেন। একইভাবে প্যারাসাইকোলজিস্ট বাসিল সাকলেটন এবং রিটা এলিয়ট কিছু ফলাফল পেতে সক্ষম হন যেটাকে কোনোভাবেই কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

তবে কেন একজন অন্যের মনোজগতে বিচরণ কিংবা চেতনাকে আচ্ছন্ন করতে পারছে, সে রহস্য আজো অজানা। অধিকাংশ বিজ্ঞানীর ধারণা প্রত্যেক মানুষেরই একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত এই ধরনের ক্ষমতা রয়েছে। আর এই ক্ষমতাটা কাজে লাগানোর জন্য সুতীক্ষ্ন মনোসংযোগ প্রয়োজন। টেলিপ্যাথি পরীক্ষার একটা সহজ প্যাটার্ন আছে। এ ক্ষেত্রে সাবজেক্ট এবং পরীক্ষক মুখোমুখি বসেন আর পরীক্ষকের সামনে থাকে একটা মনিটর যেখানে একটার পর একটা ছবি অথবা চিহ্ন উৎপন্ন হতে থাকে। পরীক্ষকের সামনে যে ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে টেলিপ্যাথকে (সাবজেক্ট) সেটা বলতে বা এঁকে দেখাতে হয়। টেলিপ্যাথ পরীক্ষকের মস্তিষ্কের ইমেজটা পড়তে পারে এবং তার ওপর ভিত্তি করেই ছবি আঁকে। বছরের পর বছর এই পদ্ধতিতে আশ্চর্যজনক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে।

ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী রুপার্ট শেল্ডরেক এই মরফোজেনাটিক ফিল্ডের সূত্র আবিষ্কার করেন। এই সূত্রানুযায়ী প্রকৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে, যা পরবর্তী প্রয়োজনানুসারে অন্যদের কাছে পৌঁছে যায়। তার বিখ্যাত উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, ব্রিটিশ বংশীয় চিকাডি নামক পাখির দুধ চুরির কৌশল। তার ভাষ্য অনুযায়ী কিছু পাখি যখন দুধের বোতলের অ্যালুমিনিয়ামের ঢাকনা খুলে দুধ চুরি করা শিখেছিল সেই কৌশলটি বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ঐ প্রজাতির পাখিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু তাই নয়, খুব দ্রুত ইউরোপ মহাদেশীয় অন্যান্য পাখিও একই কৌশলে দুধ চুরি করা শুরু করে দেয়। এটা সম্ভব হয়েছিল মরফোজেনেটিক ফিল্ডের বদৌলতে, কারণ টেলিপ্যাথি বাঁধনহীন, এটা মানুষ এবং পশু উভয়ের সঙ্গেই সমানভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।

শেল্ডরেক এই ব্যাপারটি প্রমাণ করার জন্য বেছে নিয়েছিল একটা পোষা তোতা পাখি এবং এর মালিককে। তোতা পাখিটির ভাণ্ডারে ছিল ৫০০ শব্দ এবং এই শব্দগুলোর সমন্বয়ে পাখিটি যে কোনো বাক্য বলতে পারত। এই পাখিটাকে একটা মনিটরের সামনে রাখা হলো যেখানে তার মালিক এ্যামিকে দেখা যাচ্ছিল। পাখিটির মালিক ছিল একই বিল্ডিংয়ের আরেক ফ্লোরে (পাখিটির থেকে দুই ফ্লোর নিচে)। এ্যামির সামনে ছিল কিছু খাম, যার মধ্যে ছিল কিছু ছবি এবং সিম্বল। এ্যামি খাম খুলে ছবিগুলো দেখা শুরু করল। আশ্চর্যজনকভাবে তোতা পাখিটি তার মালিকের ভিডিও ইমেজ দেখে ইংরেজিতে সেই ছবিগুলোর বর্ণনা দিতে শুরু করল, যেন সে তার মালিকের মনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে ফেলেছে। পশু-মানুষের মধ্যে এমন নিরবচ্ছিন্ন এবং চমকপ্রদ টেলিপ্যাথিক দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত আর দেখা যায়নি।

এটা ছাড়াও বিবিসি মানুষ এবং পশুর ওপর পরীক্ষার কিছু নমুনা নিয়ে ডকুমেন্টারি করেছে। অসংখ্যবার টেলিপ্যাথির এই পরীক্ষা চালানো হয়েছে এবং একই ফলাফল পাওয়া গেছে। কাজেই এটি কাকতালীয় কোনো ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই মানুষের মতো পশু-পাখিদের মধ্যেও দারুনভাবে কাজ করে টেলিপ্যাথি।

সত্যিকার অর্থে টেলিপ্যাথি ঠিক কিভাবে কাজ করে সেটি এখনো ধোঁয়াশা। হয়তো একদিন সে রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হবে। এরপরও প্রশ্ন থেকেই যাবে এই অদ্ভুত ক্ষমতার মূল রহস্যটা আসলে কোথায়। কেন এই ক্ষমতাটা বিদ্যমান। আর যদিও বিদ্যমান, কেনই বা অল্প ক'জনই এটার প্রয়োগ করতে পারে!
**রনক ইকরাম**

0 comments:

Post a Comment