Thursday, September 2, 2010

পোষাক ও পর্দা: ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্র - তরিকুল হুদা

1 comments
ধরা যাক এমন একটা পরিস্থিতি। ল্যাংটা অবস্থায় হঠাৎ একজন দেখল, অন্যকেউ তাকে দেখে ফেলেছে। তবে ল্যাংটা নিজেই তার চোখ ঢেকে ফেলে। ভাবখানা এমন; যাক বাবা বাঁচা গেল! আমার উদাম শরীর কেউ দেখল কি না--সেটা অন্তত নিজের চোখে আর দেখতে হচ্ছে না। কিন্তু না, বিষয়টা এখানেই শেষ না। এভাবে নিজের চোখ ঢেকে আর কতক্ষণ! মুখোমুখি যে দেখছে তারও যদি একই হাল হয়, তবেই না স্বস্তি আসে। ক্রমশ ল্যাংটা রাজ্য কায়েম হয়, যেখানে আর কাউকে লজ্জায় নিজের চোখ ঢাকতে হবে না। ল্যাংটাকে যে মুখোমুখি দেখে ফেলে সে নিজে কি ল্যাংটা, পর্দানশীন নাকি অন্যকিছু--এসব ভাবলে চলে না। সে তার দিকে তাকিয়েছে, চোখাচোখি হয়েছে, এতটুকুই যথেষ্ঠ। এখন গায়ে পোশাক থাকলে তা খোল। ল্যাংটারও ল্যাংটা থাকতে কেমন লজ্জা করে, খুঁতখুঁত করে। কে দেখল এইটা নিয়া মন খচখচ করে, আবার কেউ দেখুক এই বাসনাও মনে উকিঝুকি দেয়। ফরাসি দেশে হালে মুসলমান নারীদের পোশাক ও পর্দা নিয়া রাষ্ট্রের ব্যতিব্যস্ত কারবারে এমনটাই দেখা যায়। অপরদিকে পর্দা ওয়ালারা ল্যাংটাদের চাইতে কিছুটা অসুবিধাজনক অবস্থানে আছে। প্রসঙ্গত ফরাসি দেশে তারাই বস্ত্র হরণের শিকার। শিকারী নন। লোকালয়ে এখন তাদের বে-পর্দা করা হচ্ছে। আইন পাশ হয়েছে। জনসমক্ষে পর্দার উপস্থিতি নিষেধ, যার তোড়জোড় শুরু হয় বহুত আগে।

পর্দার বিরুদ্ধে ফ্রান্সে সরকার বিরোধী দল সবাই একাট্টা। শাসক দলের সংসদীয় নেতা জাঁ ফ্রাঁসোরা কোপের ভাষ্য, সমাজে নারীর অবস্থাই আধুনিকতার পরিমাপক। মূল বিরোধী দল সমাজতন্ত্রীরা জোরালভাবে বোরকা-নিকাব তথা পর্দার বিরোধিতা করছে। তারা মনে করে, বোরকা-নিকাব মাত্রই নারীর বন্দিত্ব। কিন্তু তারা আইন নিয়া জবরদস্তির পক্ষপাতি না। এ বছরের জুলাই মাসে ফ্রান্সের জাতীয় বাসতিল দিবসের ঠিক আগের দিন তের তারিখে ৫৫৭ আসনের সংসদে ৩৩৫:১ ভোটে এ সংক্রান্ত বিল পাশ হয়। ভোটের পরে আইনমন্ত্রী মিশেল মাখি বলেন, গণতন্ত্র ও ফরাসি মূল্যবোধের জয় হয়েছে। বোরকা নারীর বিচ্ছিন্নতার চিহ্ন অতএব তাদের মুক্ত করতে হবে--এমনটা মনে করেন, শাসক দলের আরেক এমপি পোলেতি। কমিউনিস্ট নেতা আঁদ্রে জেরিনের মতে, বোরকা হল চলমান কফিন। সরকারি সংস্থা ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল অব দি মুসলিম ফেইথের শীর্ষনেতা বোরকা আইনের বিরোধিতা করেন নাই। কিন্তু আইন করার ফলে অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন। মজার কথা তাই না? রাষ্ট্রপতি সারকোজির কাছে পর্দানশীন বোরকা পরা নারী হল ‘পর্দার অন্তপুরে বন্দিনী... সমাজ বিচ্ছিন্ন, পরিচয়হীনা’। শুধু তাই না, বোরকাওয়ালীদের কারণে ফরাসি অমুসলিমরাই নাকি এখন বিচ্ছিন্ন হবার পথে। এধরনের বক্তব্যে ফরাসি জাতিসত্তা, রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ এবং নারীমুক্তির যুক্তিই জোরেশোরে ব্যবহার হচ্ছে।



বিষয়টা নিয়া তর্ক তুঙ্গে। তবে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও কয়েকজন আলোচনা তুলেছেন। প্রচলিত মতের জবরদস্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তারা বেশ শক্তিশালী চিন্তার খোরাক জোগান। সেখান থেকে কয়েকটা লেখা এই নিবন্ধে আমরা পরখ করব। ইওরোপীয় ভাবুক স্লাভো জিজেক ‘বোরকার ভেতরের পড়শি’ (দ্য নেইবার ইন বোরকা) নামক ছোট রচনায় বলেন, এই আইনের ফলে মুসলিম নারীদের বঞ্চনা আরো বাড়বে। তারা আরো বেশি করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। জিজেক মনে করেন, মাত্র দুই হাজারের মত বোরকাওয়ালী নিয়া তামাম ফরাসিদের এই উৎসাহ ঠিক স্বাভাবিক না, বিশেষ লক্ষণাক্রান্ত। মুসলিম নারীর এমনিতেই জেরবার দশা--এটা জিজেক ধরেই নিয়েছেন। তাই বোরকা নিষেধাজ্ঞা নিপীড়নের মাত্রা আরো বাড়িয়ে তুলবে বলে মহাত্মার উদ্বেগ। আমার আশঙ্কা খোদ এই ধরে নেয়া, ফরাসিদের চাইতে জিজেককে খুব আলাদা করে না। ঘুরেফিরে শেষতক একই জায়গায় এসে ঠেকে, এটা অবশ্য তাঁদের সাধারণ লক্ষণ। দুইহাজার তো অনেক বড় সংখ্যা। শুধু একজন বোরকাওয়ালীও ফ্রান্সে বসবাস করলে বা না করলেও আইন হত অনুমান করা যায়। যে জমানায় আমরা বসবাস করছি--ইতিহাসের এই ক্ষণে পর্দা আর বেপর্দার তাৎপর্য সংখ্যার হিশাবে কোনভাবেই বুঝা যাবে না। ফ্রান্সে একজন মুসলিম নাগরিকও যদি না থাকত তাও প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধের কথা বলে হিজাব নিষিদ্ধ হত। ইসলামে নারী বঞ্চনার ধুয়া তুলে আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন জায়েয করা হয়। এখানে সাম্রাজ্যের হম্বিতম্বির বাইরে এক ফোঁটাও নারীবাদ নাই।

যাই হোক, নারীত্বের অবমাননা-অমর্যাদা এসব কথা বলে আবার থেমে যান নাই কেউ। ফরাসি সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের সামনে আব্রু-পর্দা-হিজাব-নিকাব অস্তিত্বের সংকট, এক আতঙ্ক আকারে হাজির হয়েছে। এখানে জিজেকের প্রশ্ন--কেন এই ভয়, শঙ্কা? সামান্য নিকাব ঢাকা মুখ দেখে কুঁকড়ে যায় কেন ফরাসি প্রজাতন্ত্র ও নাগরিকগণ? ওই মুখ কি তাহলে ইমানুয়েল-লেভিনার ‘অপর’র মুখ নয়? যে ‘অপর’ বিনাশর্তে নৈতিকতার আহবান ছড়ায়? জিজেকের প্রস্তাব মতে, ঘটনা ঠিক উল্টাইয়া যায় যদি আমরা ফ্রয়েডের চোখে ব্যাপারটাকে দেখি। মুখ দেখে যায় কি চেনা? মুখের আড়ালে পড়শি লুকায় তার সকল যন্ত্রণা। তাহলে মুখই তো মুখোশ। কিন্তু‘ এসব কি আর টের পাই আমরা। শুধু সেই মুখ দেখে আরাম পাই, মনে হয় চেনা চেনা লাগে। যেন আমারই মত। তাহলে এই মুখ ঢাকলে তো গা শিউরাবেই। অস্বস্তি ও অচেনা লাগবেই। নিকাব ওই মুখকে ঢেকে ফেলে--যেই মুখ এতদিন অন্য কিছু ঢেকে রেখেছিল। মুখের অন্তরালে সব গহবর আর ফাঁকা শূন্যতা হুট করে সামনে চলে আসে। বাঁধামুখ আর তাকে রুখতে পারে না। এখন সেই অন্যকিছুর চোখ ধীরে ধীরে মেলতে থাকে। কিন্তু‘ রূপহীন এই অ-রূপ না দেখলে, সে যে কত রূপসী তা বুঝার উপায় নাই। এরকম অ-রূপ পড়শিকে চিনলেই পরে সম্পর্ক অর্থময় হয়। যে মুখ সবকিছু আড়াল করে তাকে আড়াল করতে হবে। জিজেক স্মরণ করান, মুখ নামক মুখোশ ঢাকলে পরে পড়শি তার আসল জায়গায় দাঁড়াতে পারে, চোখ তুলে তাকাতে পারে। মনোবিশ্লেষণে দাওয়াই প্রার্থীকে দাতার মুখোমুখি বসানো হয় না। উভয়ই তৃতীয় কোন বিন্দুতে চোখ রেখে কথা বলে। জিজেকের মতে, এটাই পড়শির জগত। কিন্তু‘ এই খতিয়ানে পড়শির জগতে সবকিছু তালাশ কিভাবে সম্ভব? শুধু পড়শি যার ‘অপর’ তাকে খানিক বুঝা যায়। পড়শির বাসনা কি? সে কি এই খতিয়ানে নিছকই দাগ মাত্র?

এরপর ফরাসি ঘরের ছেলে আলা বাদিউ’র কথায় আসি। এ বিষয়ে তাঁর ‘ওড়না আইনের পেছনে আতঙ্কের বসবাস’(বিহাইন্ড দ্য স্কার্ফ ল দেয়ার ইজ ফিয়ার) লেখায় নজর ফেরানো যাক। লেখাটা তুমুল রাজনৈতিক, আবার রস আর খোঁচায় ভরপুর। স্কুলে বালিকাদের মাথায় ওড়না নিষিদ্ধ করার সময় এই লেখাটা বাদিউ লেখেন।

বলা হয়, পিতা আর ভাইদের কারণেই মুসলিম নারীর বেহাল অবস্থা। বাপ-ভাইদের অত্যাচারের চিহ্ন হিজাব। কাজেই হিজাব নিষিদ্ধ কর। যেহেতু নারী ধর্ষিত সুতরাং তাকে নিরাপত্তার নামে জেলে ঢুকাও। বাদিউ মনে করেন, এই ধরনের যুক্তি দিয়েই ফরাসি শাসকগোষ্ঠী হিজাব নিষিদ্ধ করেছে। না হলে, পিতার অপকর্মের শিকার হয়েও তাকেই দায় গুনতে হচ্ছে। আর যদি স্বেচ্ছায় কেউ হিজাব পরে? তাহলে তো জাতীয় শত্রু, পুরাদস্তুর বিদ্রোহী। এখনই শাস্তি দিতে হবে। আচ্ছা, তাহলে এই মেয়ের কোন বাপ-ভাই থাকার দরকার নাই। নিজেই তো বেয়াড়া। এই বেয়াদব মেয়ে, নিপীড়িত নারী এবং বাপ-ভাইয়ের শ্রেণী পরিচয়ের সন্ধান দিয়েছেন বাদিউ। এককালের ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়া এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে ছুটে আসা এসব মোহাজের মুসলমানরাই ফ্রান্সের প্রান্তিক শ্রেণী। বাদিউর ঘোষণা খুবই পরিস্কার: ইসলাম হল ফ্রান্সে মজলুমের ধর্ম। কিন্তু‘ ধনতন্ত্র বা পুঁজিতন্ত্র তারচে বড় ধর্ম। আর তার চিহ্ন চারপাশে ভুরিভুরি। দ্রব্য, ভোগ্যসামগ্রী? কি দেখি নাই আমরা? সবকিছুই পুঁজিতন্ত্রেরই প্রকাশ। তাই বাদিউর আহবান, ধর্মতাত্ত্বিক চিহ্ন হিশাবে হিজাব নিষিদ্ধ হতে পারলে চিহ্ন হিশাবে পুঁজিতন্ত্রের পণ্য পসরার বিজ্ঞাপনও নিষিদ্ধ হোক।

হিজাবের আড়ালের নারী সম্পর্কে শাসকশ্রেণী এবং নারীবাদীরের মতের আশ্চর্য মিল পাওয়া যায়। তারা উভয়ই মনে করে মুসলিম নারীরা আসলে সশরীরের অংশ ঢেকে ফেলার মাধ্যমে নিজেরা জনসমক্ষে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আসলে সমাজ বিচ্ছিন্নও বটে। এরকম কোন নীতিমালা অন্তত নারীবাদী বা প্রজাতন্ত্রীদের নাই, যার মাধ্যমে তারা শরীরের কোন অংশ ঢাকা থাকবে বা উন্মুক্ত রাখবে এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারে। এখনও কোন স্কুলে স্তনের বোঁটা বা গোপনকেশ প্রদর্শিত হয় না। তা ঢাকাই থাকে। তাহলে এর বিরুদ্ধে কেন অন্যের দৃষ্টি হতে সরায়ে ফেলার অভিযোগ আনা হয় না? বাদিউ আরো বলেন, এখনও ফ্রান্সের সিসিলিতে বিধবারা কালো স্কার্ফ পরে। এতে অবশ্য ইসলামি সন্ত্রাসীদের বিয়ে করার দরকার পড়ে নাই।

হিজাবে নারীবাদীদের চুলকানি দেখে বাদিউ বেশ আমোদ পান। নারী শরীর ভোগ্যপণ্যের মত বাজারে ছড়ানো ছিটানো, বেচাবিক্রি হচ্ছে। অথচ তারা কিনা ফরাসি রাষ্ট্রপতির কাছে গুটিকয়েক হিজাব ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হাতজোড়ে ব্যস্ত। নারীদের যা কিছু সম্বল তাতো অবশ্যই দেখাতে হবে। বেচতে হবে। নিয়ন্ত্রিত বিনিময় না বরং বিস্তৃত সর্বজনীন বাজারই তার ঠিকানা। বাদিউর সিদ্ধান্ত, হিজাব আসলে পুঁজিতান্ত্রিক আইন। লক্ষ্য হল, নারীর শরীর পুঁজির নিজস্ব সূত্রে বাঁধা। নারীকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন, যত দামই হোক তা বিকোয়। সবাই বলে পর্দা নাকি নারীর ওপর অগাধ নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। কিন্তু‘ নারীত্ব কি আর কোনভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয় না। যা অতিশয় হাস্যকর চিন্তা।

যে সময়ে আমরা বাস করছি এখন, ইতিহাসে নারীর শরীর, যৌনতাকে এত বেশি প্রাধান্য আর কখনোই দেয়া হয় নাই। সে কি খাবে, কিভাবে ঘুমাবে, কি রঙ মাখবে...হেন...তেন... যেন শেষ নাই। মজা মারাটাই এখন ধ্যানজ্ঞান। একটাই কথা, “নারীগণ মজা মার, আরো বেশি মাস্তি কর”। মহাত্মা জাঁক লাকা শরণে বাদিউ বলেন: পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আর যাই হোক, বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণের মত এত ব্যাপক, চিরায়ত ও নিশ্চিত না। সেকুলারিজম এমন এক জ্ঞানব্যবস্থা যা কিনা শুধুই পশ্চিমা রীতিনীতির ধারক। অন্য ধরনের আদর্শবোধের প্রতি যারপরনাই আক্রমণাত্মক। ওখান থেকে নির্গত হওয়া নারীবাদও এর বাইরে না। ‘পশ্চিমা’দের ‘অপর’কে কখনোই লেভিনার ‘অপর’র তত্ত্ব দিয়া ব্যাখ্যা করা যায় না। যেখানে অর্থবহ বিশেষকে নাকচ করে এক বিমূর্ত ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক সামান্য ধারণার বিকাশ ঘটেছে। সেই ব্যবস্থার অন্তর্গত শিক্ষালয়গুলাতে নাগরিকদের প্রজাতান্ত্রিক মূল্যবোধের চাইতে আর অন্য কিছু শিখানোর কথা ভাবাই যায় না। তো সেখানে প্রজাতন্ত্রের নীতি বৈ অন্য কিছুকে নির্দয়ভাবে নিশ্চিহ্ন করাটাই স্বাভাবিক।

বাদিউর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হল মৃত্যু সংক্রান্ত। পশ্চিমারা বিশেষ করে ফরাসিরা মরণরে ডরায়। কোন আদর্শের জন্য মানুষ তার জীবনকেও বিকিয়ে দিতে পারে--এটা ভাবা বা কল্পনা করা তাদের সামর্থ্যরে বাইরে। শূন্য ও অর্থহীন মরণই ফরাসিদের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বাসনা। বহু মানুষ মরণকে ডরানোর কোন কারণ খুঁজে পায় না। এমনকি তাদের কেউ কেউ প্রতিদিন এক আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে--এটা তথাকথিত ‘সভ্য’দের জন্য ভয়াবহতম আতঙ্ক। পাঠক, বাদিউর মত আপনিও বুঝবেন, কিভাবে নিবেদিত আদর্শিক মানুষ তার নিজেকে বোমার আধার বানায় আর তার বিপরীতে সারি বেঁধে উড়তে থাকে মনুষ্য শরীরবিহীন ড্রোন বিমান। ড্রোন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কোন মানুষটা অমর জানতে ইচ্ছা হয়।

বাদিউ জোর দিয়ে বলেন যে, কেবল ভয়ই ওড়না-আইনে খোলাখুলি প্রকাশিত। কিন্তু‘ কিসের ভয়ে কাতর তারা? ওই একই কথা বর্বর,... ইসলামি জঙ্গি... এসব আর কি।

সবশেষে বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ অধ্যাপক তালাল আসাদের ‘ফরাসি ধর্মনিরপেক্ষতা বুঝার কোশেশ’ লেখাটায় আসি। অনেক কারণে লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। যে প্রচলিত বিশ্বাসে ভর করে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র নাগরিক মাত্রই একই মূল্যবোধের ধারক বানানোর ন্যায্যতা পায়, তালাল শুরুতেই তাকে প্রশ্ন করেন। জিগান, জাতীয় জনগোষ্ঠী বানানোর জন্য নাগরিকবৃন্দের সমসত্ত মূল্যবোধের ভাগিদার ভাবা শহুরে সমাজের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে কিনা নানা রঙের মানুষের বসবাস। ইহুদি-খ্রিস্টান সিলসিলা ইওরোপীয় মূল্যবোধের মূল উপাদান। তাই, মুসলিম মোহাজেরদের প্রতি আপনাআপনিই অস্বস্তি তৈরি হয়। মুসলিম মূল্যবোধ ইওরোপের জাতিরাষ্ট্রীয় ঐক্যের ধারণায় কি বিরূপ প্রভাব ফেলে তা ভেবে ভেবে ব্যাকুল তারা। ইওরোপীয়রা এখন ইসলাম আতঙ্কে আচ্ছন্ন। তাদের পবিত্র বিশ্বাস--ইসলাম তার বাইরে কোন কিছুকেই পরোয়া করে না। আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে গণতন্ত্র মানে সবসময় সহিষ্ণুতা বা মেনে নেয়া নয়। অন্যায় অবিচারকে বৈধতা দেয় এমন অনেক কিছুর বিরোধিতাকেও শায়েস্তার নিমিত্তে গণতন্ত্র নিরলস কাজ করে। তালাল মনে করেন--ঐক্য নিয়ে মনকে আগাম বেড়ি পরানো শাসক চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য।

ঐক্য-মিলন ইত্যাদির গান গাওয়া রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতকরণের অংশ। ইতিহাসে এর নানা উদাহরণ টেনে তালাল নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতি মোতাবেক লাইসিতের (ফরাসিতে ধর্মনিরপেক্ষতা বুঝাতে লাইসিতে শব্দটা ব্যবহার হয়) বিশ্লেষণে সচেষ্ট হন। স্বাভাবিকভাবেই তালাল ফ্রান্সের নতুন আইনগুলি বিশ্লেষণ করতে স্টাসি কমিশন প্রতিবেদন পুঙ্খানুপুুঙ্খ বিশ্লেষণে নামেন। দুই হাজার তিন-চার সালের দিকে মুসলমান বালিকাদের ওড়না পরার ওপর খবরদারি জারি হয়। কারণ হিশাবে অনেক গবেষক মুসলমানদের দোষ শনাক্ত করেন। ফরাসি সমাজে তাদের একাত্ম হবার অনীহাকে দায়ী করেন। তারা উগ্রবাদী ইসলামের প্রতি আকর্ষণ, বিকৃত বর্ণবাদ, অর্থাভাব, মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের উসকানি, ইসলামি ওয়েব সাইট সমূহের প্রচার ইত্যাদি কারণও আবিষ্কার করেন। কিভাবে পবিত্র ফরাসি মূল্যবোধ এসব উৎপাত ধারণ করবে? সংখ্যাগরিষ্ঠ ফরাসি গবেষক বুদ্ধিজীবী বাম-ডান সহ বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে যে, ইসলামি কিছু চিহ্ন ও চর্চার কারণে প্রজাতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংসের পথে। ফরাসি ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি খুব সরল সহজ চিন্তার ওপর মোটেও প্রতিষ্ঠিত না। ষোড়শ শতকে পশ্চিমা খ্রিস্টতন্ত্র ‘রাজ ধর্মই প্রজার ধর্ম’ নীতি গ্রহণ করে। ধর্মনিরপেক্ষতার গোড়া এইখানেই। ‘বিশেষ’ ধর্ম সংক্রান্ত সমস্যা সাধারণ রাজনৈতিক নীতির ভেতর সমাধানের রাস্তা এভাবেই তৈরি হচ্ছিল সে সময়। আধুনিকতাই ইতিহাসে প্রথম ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে নাই। মধ্যযুগে খ্রিস্টান জগতেও এই বিভাজন অভাবনীয় ছিল না। যদিও আজকালকার মত একই অর্থে নয়। রাজতন্ত্র ও চার্চ এক জটিল আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। পরে এক রাজার দুই শরীর (প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক) তত্ত্ব প্রবর্তন হয়। রাজদেহে প্রবাহিত, খ্রিস্টান ধর্মীয় সত্তা ও রাষ্ট্র সত্তা আলাদা করণের জরুরত প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক বলয় থেকে ধর্মকে বের করে আনা হয় বা আত্মীকরণ করা হয়। প্রচলিত অর্থে, আধুনিকতার আবির্ভাবের ফলেই রাষ্ট্র ও চার্চ আলাদা--এই চিন্তা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেও তার চর্চা ছিল। অর্থাৎ এর গোড়া ধর্মের ইওরোপীয় ধারণা ও রাজতন্ত্রের ভেতর পোঁতা আছে।

ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হবস’র প্রস্তাব মোতাবেক রাষ্ট্র এক বিমূর্ত, অতিন্দ্রিয় সত্তা। যা কিনা শাসক এবং শাসিত পরিমণ্ডলের বাইরে স্বাধীন অস্তিত্বে বিরাজমান। ফলত, বিভিন্ন জাত-পাত বিশ্বাসের অনুসারী নানা ধর্মের মানুষের জাতীয় দায়িত্ব-কর্তব্য এবং আন্তঃসম্পর্কের ফয়সালা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নির্ধারণের রেয়াজ চালু হয়। নিজেকে হাজির করার জন্যও রাষ্ট্রের দরকার হয় চিহ্ন ও প্রতীকী ব্যবস্থার। যা কিনা যেকোন রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে আধুনিক রাষ্ট্রের। কেননা তাকে হরহামেশা নিজেকে প্রকাশ করতে হয়। সাথে সাথে অন্যকেও আলাদা করতে হয়। সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার নামে ফরাসি বিপ্লবের সময় ধর্মকে বিশেষত ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে আক্রমণ করা হয়। লোকালয় দখলের সাথে সাথে ধর্মকে ব্যক্তিগত চর্চার বিষয় বলে অভিধা দেয়া হয়। শুরু হয় চার্চ আর গণক্ষমতার সরাসরি টক্কর। এ সংঘাতের মীমাংসা হতে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল ফরাসিদের। তৃতীয় প্রজাতন্ত্র মানবতা, মুক্তি, সাম্য ইত্যকার আদর্শের নামে নাগরিকদের সভ্যকরণের জন্য ছয় থেকে তের বছরের বাচ্চাদের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করে। দেশে মোল্লাতন্ত্র বিরোধী শিক্ষার প্রসার, চার্চের সাথে অসম চুক্তি এবং বাইরে ঔপনিবেশিক বিস্তার--এই তিন ভিত্তির ওপর লাইসিতের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এটাই ফরাসি জাতীয়তাবাদের জন্মের মুহূর্ত। ফরাসি উপনিবেশ থাকলেও আলজেরিয়ার ইতিহাস এই পথে আগায় নাই।

আসলে আধুনিক ফরাসি রাষ্ট্রও ‘রাজ ধর্মই প্রজার ধর্ম’--এই নীতির ওপরই আছে। রাষ্ট্র যেমন সবার ওপরে আবার তা প্রতিনিধিত্বশীল কর্তাসত্তাও বটে--দুর্খেইম যেমনটা ভাবেন। অথবা হবস যেমনটা দেখান যে, রাষ্ট্র সমস্ত রাজনীতিক-জনগোষ্ঠীর চাইতে এমনকি অপ্রাকৃতিক শক্তি হতেও স্বাধীন এবং সার্বভৌম।

যা ইচ্ছা তাই করতে পারি মার্কা রাষ্ট্র কোন চিহ্ন বা প্রতীকের কি মানে, তা ঠিক করার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। হোক তা ধর্র্মীয় অথবা সেকুলার। এমনকি এটা যে শুধু লোকালয়ের মধ্যে সীমিত তা মোটেই নয়। কারণ সদর-অন্দর সবকিছুর সংজ্ঞা তো আদতে রাষ্ট্রই নির্ণয় করে দিচ্ছে। সেই আলোকে পাঠ করলে স্টাসি রিপোর্ট বুঝতে খানিক সুবিধা হয়।

তালাল খেয়াল করেন যে, স্টাসি রিপোর্ট সরব চিহ্ন (conspicuous religious signs) এবং নিরব চিহ্ন (discreet signs) এর ভেতর ফারাক টানছে। পর্দা (বোরকা, নিকাব...ইত্যাদি) কিম্বা গলায় বড় ক্রশ উল্লেখিত প্রথম ঘরানার আর মেডালিয়ন, ছোট ক্রশ, ডেভিডের তারা, ফাতিমার হাত বা ছোট কুরআন ইত্যাদি দ্বিতীয় ঘরানার। তালালের দাবি, মুসলিম নারীদের কাছে মাথায় ওড়না পরা বা পর্দা গ্রহণ করা ধর্মীয় কর্তব্য। কিন্তু‘ কোন নিরব চিহ্ন বহন করার কোন আবশ্যকতা নাই। তার কাছে পর্দা কোনভাবেই নিছকই কোন চিহ্ন মাত্র না। বরং তার সত্তার অনিবার্য অংশ। কিন্তু রিপোর্টে তা শুধু একরৈখিক স্থির অর্থ বিশিষ্ট ধর্মীয় চিহ্ন, ব্যাঞ্জনাহীন ধবধবে সাদা। বিভিন্ন ধর্মীয় চিহ্নের মুক্ত প্রকাশ ব্যক্তি অধিকারের অপরিহার্য অংশ যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। একটা অতিক্ষুদ্র অংশের গুটিকয়েক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই ‘আধিপত্য বিস্তার’র অর্থ একেবারেই পরিস্কার না বলে তালাল মনে করেন। শুধু চাক্ষুষ না, এমনকি মানসিক প্রক্রিয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। যেমন অভিপ্রায়, বাসনা ইত্যাদি। ‘মুসলিম পরিচয়ের সাথে অনিবার্য দিক হল এই পরিচয় প্রকাশের অভিপ্রায়’। এমনিভাবে কমিশন ‘বাসনা’র মনগড়া অর্থ তৈরি করে।

মাথায় কাপড় দেব কি দেব না--এই দ্বৈততার ভেতর কমিশন দ্বিতীয় সম্ভাবনাই বেছে নেয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। এই বেছে নেয়া লাইসিতের সাথে যায়। ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিটি নাগরিকের আপোষহীন অধিকার--যদিও এই নীতির সাথে বেখাপ্পা। তালাল জোর দেন বাসনার ব্যখ্যার ওপর। বাসনাকে নিমিত্ত বস্তু পর্দা থেকে আলাদা করা হয়। ফলত সেই বাসনা হয়ে যায় সাধাসিদা, যাকে কিনা অংকের হিশাবে বুঝা যায়। ‘বাসনার স্বরূপে কোন ধর্ম বা অধর্ম নাই, এসব হল সোজাসাপ্টা সামাজিক ঘটনা’। কাজেই প্রজাতন্ত্র সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কার অর্থ কি। আর সেটাই চূড়ান্ত। এমনকি রাষ্ট্রই বেঁধে দিচ্ছে ব্যক্তিগত বলয়ের চৌহদ্দি। আবার যা কিছু ব্যক্তিগত তাকে লোকালয়ে টেনে আনছে। এই লোকালয় হচ্ছে লিবারেল গণতান্ত্রিক ভরসার জায়গা। প্রজাতন্ত্র কখনই চাইবে না যে, নাগরিকরা রাষ্ট্রের চাইতে বেশি দূরত্বে অবস্থান করুক।

গোড়ায় ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখযোগ্য কিছু দ্বন্দ্বমূলক বৈশিষ্ট্য ছিল। যেকোন ধর্মীয় ব্যাপারে নিজেকে গুটায়ে নেওয়া, এমনকি ধর্মীয় চিহ্ন নির্ধারণ-সংজ্ঞায়ন থেকেও বিরত থাকত রাষ্ট্র। অপরদিকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল নাগরিকের ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষায় শিক্ষিত করা। বিচারকরা স্বাভাবিকভাবেই ভাবতেন যে, ধর্মীয় চিহ্নের অর্থ নির্ধারণ তাদের কাজ না। এটা তাদের এখতিয়ারের বাইরে। ফলত পর্দা নারী-পুরুষে বৈষম্য তৈরি করে কিনা তা নির্ণয়ও বিচারকদের কাজ ছিল না। প্রভাবশালী মহল বিচারকদের এহেন নির্লিপ্ততায় নাখোশ তা স্টাসি রিপোর্টে বুঝা যায়। রিপোর্টের অন্যতম লক্ষ্য আইনই অর্থ নির্দিষ্ট করুক। তাই সে উদ্দেশ্যে প্রথম করণীয় হল কোনটাকে ‘ধর্মীয় চিহ্ন’ বলা হবে তা ঠিক করা। তার পরে প্রয়োজনীয় মানে বসানো যাবে। কমিশন যাকে একটি চিহ্ন বলে সাব্যস্ত করে তার নিজের অন্তর্গত কোন অর্থ নাই। তালালের সিদ্ধান্ত ‘ধর্মীয় চিহ্ন’ প্রজাতন্ত্রের এক নতুন খেলা। যার ভেতর আধুনিক রাষ্ট্র নিজেরে জারি রাখে।

রাজনৈতিক শক্তি ও ধর্ম আলাদা ও স্বাধীন। কেউ কারো ওপর প্রভাব খাটাতে পারবে না। স্টাসি কমিশন এইসব দিকের ওপর জোর দিয়েছে। তবে রিপোর্ট পাঠে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক এখানে অসমান। ধর্ম যদিও রাষ্ট্রকে ঘাঁটায় না। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রের দিক থেকে ব্যাপারটা মোটেও এমনটা না। তাই তারা অসমান। কারণ রাষ্ট্রের ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা। তালালের সূত্রায়ন ইহাকেই বলে সার্বভৌম ক্ষমতা। মহান রাষ্ট্রতত্ত্ববিদ কার্ল শ্মিটের বরাতে বলেন, লাইসিতে ব্যতিক্রমেরই (state of exception) প্রকাশ। সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। লাইসিতে সেই সার্বভৌম ক্ষমতারই উপস্থিতি। যার যথেচ্ছা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের সাথে সংযুক্ততা-অসংযুক্ততা নির্ধারণ ও নির্ণয় করা হয়।

ফ্রান্স নানা ধরনের ধর্মীয় সম্প্রদায়-দল-গোষ্ঠী দেখা যায়। ভর্তুকিপ্রাপ্ত ধর্মীয় স্কুল ধর্মীয় সংস্থা ইত্যাদি কার্যকরভাবে ফরাসি সেকুলার কাঠামোয় অস্তিত্বশীল। তালালের প্রশ্ন এসব সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা কি সাম্প্রদায়িকতা না?

বিরাজমান এইসকল গোষ্ঠী সম্প্রদায় কোনভাবেই সমান ক্ষমতা অর্জন বা প্রয়োগ করতে পারে না। কাজেই তাদের ক্ষমতা বিন্যাস মোটেও সুষম না। ফলে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলার প্রতি রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার যেই গান গাওয়ার ভান রাষ্ট্র করে তা সমস্যাজনক। নাগরিকতা এবং জাতীয়তার সাথে সম্পৃক্ততার বোধ সবসময় নিশ্চিত, নিরাপদ ও দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে না। মতভেদের প্রতি সহিষ্ণুতা না, বরং সার্বভৌমত্বই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। যা কিনা ব্যতিক্রম অবস্থাকে নির্ণয় করে এবং সায় দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতাকে তালাল একেবারেই সহিষ্ণুতার সূত্র মনে করেন না। সেকুলারিজমকে যারা শত্রু মনে করে, সেকুলারিজমও তাদের শত্রু মনে করতে কসুর করে না। তাদের ওপর চরম নিষ্ঠুরতা, ত্রাস প্রয়োগ করতে পিছপা হয় না।

আগামবেনের মতে, বিশ্বে এখন ব্যতিক্রম অবস্থাই চলমান। এমতাবস্থায় লিবারেল গণতান্ত্রিকরা গোলমাল এড়াতে এবং ‘আইনের শাসন’ কায়েম করতে শুধু নির্বাহি বিভাগীয় সরকারি আদেশ জারি করেই ক্ষান্ত হন না। বরং আইনের চোখ বেঁধে গোপন সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়। আধুনিক জগতে শান্তি কায়েমের জন্য অনিবার্যভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র দাওয়াই নয়।

তালাল হাত দেন পবিত্র ত্রিত্ব ধারণায়। সাম্য, স্বাধীনতা, মৈত্রী। এই ত্রিত্বই প্রজাতন্ত্রের মোহর। যার ব্যাপারে কোন অসহিষ্ণুতাই প্রজাতন্ত্র সহ্য করবে না। স্বাধীনতা, সাম্য না হয় নাগরিকের আইনগত অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু মিত্রতা (fraternity) কি চিজ? এর ভিত্তি কি? নানান কিসিমের ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভেতর কেমনে এই সম্পর্ক রক্ষা হয়? তালালের ভাষায় মিত্রতা আসলে আদর্শিক প্রভাব--জাতির সাথে কর বন্ধন। লাইসিতে যে শুধু আইনি ব্যাপার না, মিত্রতা--তার লক্ষণ কি? ভিনসেন্ট গেইসার ফ্রান্সে মুসলিম জনগোষ্ঠীর দূরবস্থা এবং তাদের যে বিরূপ এবং শত্রুতামূলক আচরণের অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয় প্রতিনিয়ত সেইসব ঘটনার দলিল দাখিল করেন। তার মতে, ইসলাম এবং মুসলিমদের এমন দুর্দশার শিকড় উপনিবেশের ভেতর প্রোথিত। সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব সন্ত্রাসীর অভিধা। নানা অনুভূতি-বিস্ময়-বিরক্তি-তিক্ততা ইত্যাদি মিশে আছে এই দ্বন্দ্বে, আর তা ঐতিহাসিক মুসলিম সালতানাত পার হয়ে প্রজাতন্ত্রের সেকুলার প্রকল্পের অংশ হচ্ছে। যার লক্ষ্য এমন এক জাতীয় কর্তাসত্তা নির্মাণ, যা আইনি, অ-আইনি বা মনোজাগতিক--সর্বোতভাবেই ইসলামি কর্তাসত্তার সাথে বেমানান হবে। এই রাষ্ট্রীয় বৈষম্য প্রকল্পে শামিল হয়েছেন অনেক বুদ্ধিজীবী, লেখক ও শিল্পী। যেমন, জনপ্রিয় লেখক মিশেল হলব্যাক, অরিয়ানা ফালাক্কি। তিনি আরও দেখান, মুসলিমদের প্রতি জনরোষ যতই বাড়ছে, ইহুদিদের সাথে শত্রুতামূলক আচরণের দায় ততই মুসলিমদের ঘাড়ে চাপছে। স্টাসি কমিশনে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইহুদি বিদ্বেষ বাড়ছে যা ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য হুমকি। এ বিষয়ে প্রতিবেদনের গোটা একটা আলাদা অংশ বরাদ্দ আছে। বলা হয়েছে ‘ইহুদি বিদ্বেষের সাথে হাতে হাত ধরাধরি করে নবরূপে ধেয়ে চলছে সেকুলারিজমের প্রতি হুমকি। এই বিদ্বেষ ইহুদি সন্তান, সম্প্রদায়, চিন্তার অনুসারী, সংশ্লিষ্ট সকলকে লক্ষ্য করেই চালিত’।

কমিশনের প্রতিবেদক রেমি সোয়ার্ডস’র বক্তব্য আরও মজার। তার কথা হল, স্কুলে পর্দার জন্য করা আইন ১৯৮৯ সালের জন্য পর্যাপ্ত ছিল, কিন্তু পর্দা করা এখন ইসলামি হুমকির নিশানা। ‘আমরা যার মুখোমুখি তা বিশ্বব্যাপী ইহুদি বিদ্বেষের অংশ। এবং অবশ্যই একে রুখতে হবে।’ একই সমীকরণে তাহলে লাইসিতের ভিত্তি সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীকে চ্যালেঞ্জ করে--এমন বহিঃশত্রুকে রুখে দাঁড়াতেই হবে। এটাই স্টাসি কমিশনের মূল বিষয়। তালাল বলেন নাই যে, কোথাও কোন ইহুদি বিদ্বেষ নাই। বরং বিদ্বেষের গতি কাঠামোকে শনাক্ত করতে চেয়েছেন। তিনি খেয়াল করেন, ফরাসি ইহুদিদের সাথে ফরাসি রাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ জটিল। তা এতটাই স্পর্শকাতর যে, অ-ইহুদিরা এ সম্পর্কে গণমাধ্যমে খুব কমই মন্তব্য করে। ইহুদি ধর্ম বিশেষজ্ঞ ইস্থার বেনবাসা রচিত The jews of France, Zionists without zionism প্রবন্ধের বরাতে তালাল বলেন, ফরাসি ইহুদিরা ইহুদি রাষ্ট্র ইজরাইলের ব্যাপারে খুব ভাবাবেগে আক্রান্ত। দুনিয়ার তাবৎ ইহুদি ইজরাইলে অন্তর্গত। এই আদর্শের সাথে ফরাসি নাগরিক হিশাবে ফরাসি ইহুদিদের দ্বন্দ্বমধুর সম্পর্কের বয়ান প্রবন্ধটিতে পাওয়া যায়। ইজরাইল তার অন্তর্গত সব নাগরিকের রাষ্ট্র নয়। যেমন সেখানকার ফিলিস্তিনিরা। আবার বহু অনাগরিক এবং পরদেশী ইহুদির রাষ্ট্র ইজরাইল। ফরাসি মুসলমানদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হুবহু না হলেও ফিলিস্তিনি মুসলিম বা দখলকৃত ইরাকিদের প্রতি মুসলমানদের সহজাত দুর্বলতা আছে। বেনবাসা এটা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন যে, রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিশাবে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রতি জোরাল অবস্থান নিলেও ধর্ম-সম্প্রদায়গত ভিন্নতা বিশিষ্ট সমাজে তেমন খাপ খায় না। উপরন্তু মানুষরা অন্য দেশ কালের একই সম্প্রদায়ের মানুষের দুঃখ বেদনা কষ্টের সাথে আত্মপরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। যা সেকুলার রাষ্ট্র কখনো গ্রাহ্য করে না, কিন্তু ইহুদিদের বেলায় ব্যতিক্রম। মোদ্দা কথা হল, ইহুদি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ইওরোপীয় বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, রাজনীতিকরা যতটা তৎপর ততটা মুসলিম বিদ্বেষের বেলায় একেবারেই না। আধুনিক ইওরোপে জর্মান নাজিরা ইহুদিদের প্রতি যে প্রতিহিংসা প্রদর্শন করেছিল তার ধারে কাছেও যায় না আরব বা মুসলিম বিদ্বেষীদের কর্মকাণ্ড। তাহলে প্রশ্ন, আলজেরিয়ায় সংঘটিত ফরাসি ধ্বংসযজ্ঞ কি কিছুই না?

অপরাধ, পিতৃতন্ত্র--এগুলা ফরাসি সমাজে বাইরের ব্যাপার না। কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় কোন ধর্মীয় সংস্কৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিশাবে অপরাধ প্রবণতা--পিতৃতন্ত্রকে সংযুক্ত করা হয় তা পরিস্কারভাবে অপরিচ্ছন্ন। নেপোলিয়নের কানুনে স্ত্রীকে মারধর করার অধিকার ছিল স্বামীর, যা এই সেইদিন ১৯৭৫ সালে রহিত করা হয়। কিন্তু এই জন্য কখনও বলা হয় না যে, ফরাসি সংস্কৃতি মূলগতভাবে বর্বর। নারীর প্রতি সন্ত্রাস কোন অর্থেই শুধু ইসলামি সংস্কৃতির সমস্যা না। যারা মাথায় ওড়না পরে তারা মোটেই সকলেই পিতৃতান্ত্রিক জবরদস্তির শিকার না। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব এবং ইসলামি বৈপ্লবিকতার বিকাশে ফরাসি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা স্পষ্টতই ভীত। কিন্তু ফরাসি ভিত্তিগত আদর্শ কিভাবে তাতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন তা অস্পষ্ট। তালালের মতে, ১৯ শতকে ফ্রান্সের অস্তিত্বের লড়াইয়ে খ্রিস্টান চার্চের অবস্থানের সাথে বর্তমানে ইসলামের অবস্থান তুলনীয় নয়।

তালাল ফরাসি নরবিজ্ঞানী ইমানুয়েল টেরে’র কথা পাড়েন। স্টাসি প্রতিবেদন বিশ্লেষণে টেরে একে রাজনৈতিক হিস্টিরিয়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। যে প্রক্রিয়ায় প্রতীকী দমন পীড়নে বাস্তবতা ঢাকা পড়ে।

এরপর তালাল খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছুঁড়েছেন। পর্দার পক্ষে অবস্থানকারীদের মতে পর্দা তাদের ধর্মবিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে যারা গ্রহণযোগ্যতার চাপে ফরাসি সমাজের কাছে তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের অংশ বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের ব্যথার মর্ম সম্বন্ধে সেকুলার রাষ্ট্র কি অবস্থান নেয়? জবাবটা সহজ? রাষ্ট্র একই আশা করে যে, ওই সমস্ত মানুষ যেন ধর্মবিশ্বাসকে খাটো করে দেখে। বেশিরভাগ লিবারেল তাদের বিশ্বাস প্রকাশের ব্যাপারে তেমনটা আবেগ তাড়িত না। প্রথম দিককার আধুনিক নব্য স্টয়িক ভাবুকরা আবেগকে রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য ক্ষতিকর শক্তি হিশাবেই দেখে ছিল। এই সকল ভাবুকরাই আধুনিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের ভিত্তি হিশাবে শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার পক্ষে জোরালো সমর্থন দিয়েছিল। যদি এই আন্তরিক আবেগের বিষয়, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস হয় তাহলে তা কোনভাবেই ক্ষতিকর হিশাবে চিহ্নিত হয় না। কিন্তু প্রত্যক্ষবাদীদের কল্যাণে আবেগটা ধর্মীয় হলেই ভালমন্দের প্রশ্ন আসে। এরপর তালাল ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বে প্রবেশ করছেন। স্টাসি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নর-নারীর সমতা ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রস্তর স্বরূপ। এর ওপর কোন আঘাত হলে রাষ্ট্র নিশ্চুপ বসে থাকবে না। কমিশন প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য--মুসলিম স্কুল বালিকারা। যে রাষ্ট্র ইহুদি-খ্রিস্টান ধারার উত্তরাধিকার তারা কিভাবে মুসলিম নারীদের সমতা বিধান করবে। তালাল প্রশ্ন করেন--২০০৪ সালে ভ্যাটিক্যান থেকে প্রকাশিত এক দলিলে (On the collaboration of men of women in the church in the world) নর-নারীর পার্থক্য সম্পর্কে সামাজিক নানা ধারার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা হয়। প্রতিউত্তরে বিখ্যাত ধর্মীয় সমাজতত্ত্ববিদ দানিয়েল হার্ভি নেগার বলেন যে, চার্চ সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিক থাকতে সমর্থ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, চার্চ সমতার পরিপন্থী না। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে তিনি সেন্ট পলের বিখ্যাত উক্তি শোনান--‘হতে পারে না কোন ইহুদি না কোন গ্রিক, না দাস না প্রভু, না নর নারী, কিন্তু খ্রিস্টের ভেতর সবাই এক।’ তালালের মতে, এ কোন একতার কথা না। নর-নারী সমান--এতে তা বলা হয় নাই। যা বলা হয়েছে তা হল, যিশুর অস্তিত্বে সবকিছু একীভূত হবে। ঠিক যেমনটা সকল নর-নারী সম্প্রদায় একীভূত হবে নাগরিক হিশাবে। এ পর্যায়ে তালাল সঙ্গত কারণেই পাঠককে প্রশ্ন করেন--‘আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার শিকড় খ্রিস্টীয় সার্বিকতার পেটে, তা কি আমরা বুঝি?’ ঠিক--একইভাবে নারীদের ভোট প্রয়োগের অধিকার লাভের মাধ্যমেও তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় না। ভোটের নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য নাই। ভোটের ফলাফলই আসলে তাৎপর্যময়।

নারীরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল। স্বয়ংসপূর্ণ না। সেহেতু তারা পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্বের যোগ্য না। ইচ্ছার স্বাধীনতা তত্ত্বের মহাপ্রচারক রুশোর চিন্তার ধরন ছিল একই। দুর্বল নারীদের রাজনীতিতে আসার দরকার নাই। তারা বরং অন্দর মহলেই থাকুক। নারীবাদীরা স্বভাবতই রুশোর ওপর খাপ্পা। কিন্তু সুখ্যাত ফরাসি নারী ইতিহাস বিশেষজ্ঞ মোনা ওযফ মনে করেন, নারী-পুরুষের এই বিভেদ আসলে সমতা বিরোধী না, বরং বিমূর্ত সমতা ভাবের অন্তর্গত। নারী-পুরুষের বিভেদকে দূর করতে না পারলেও তাকে ঢেকে ফেলে। কাজেই বিমূর্ত সমতা এমনই এক চিজ যা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব ফরাসিরা ধারণ করে, এবং লিঙ্গভিত্তিক সমতা নিশ্চিত করার ভিত এখানেই। যখন সবাই একমত হয় যে, ব্যক্তি তথা নাগরিক সমতার সমস্ত পার্থক্যের ওপরে--তখন আর বিভেদকে জোর করে দূর করার দরকার হয় না। তা এমনিতেই ঘুচে যায়। ঢাকা পরা বিভেদকে স্বীকার করে নেয়া হয় তাদের অন্তর্গত বিভেদকে অভেদে রূপান্তরের মাধ্যমে না, বরং অন্য কোনও আদর্শের আড়ালে। অবশ্যই এক্ষেত্রে ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক বোধই সেই আদর্শ। এটাই হল ওপরের আর তলার ভাবের সম্পর্ক। এই সম্পর্কের ভেতর তারা পরস্পরকে নাকচ করে না, বরং যুক্ত করে। কিন্তু দুনিয়ার সব কাক কালো না, দুই একটা সাদা কাক আছে বটে। তালাল বলেন, বিভেদ সমতার বিরুদ্ধ না, বরং অন্তর্গত--এই সত্য ইসলামের পর্দার বেলায় খাটে না। বিভেদ ও সমতার পারস্পরিক সম্পর্ক যেই নিয়মে সিদ্ধ হয়, পর্দা সেই নিয়মের ধার ধারে না। তাইতো জোর করে পর্দা নিষিদ্ধ করা হয়। নারীর ওপর যে নিষ্পেষণ চলছে তার দায় পর্দার মাধ্যমে আবার তার ওপরই চাপানো হচ্ছে--হিজাবের বিরুদ্ধে নারীবাদীদের খুব প্রচলিত এই অভিযোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তালাল। পর্দা কখনও লিঙ্গ ভিত্তিক ভেদকে লুকায় না। ইসলামি আইনেও পুরুষালী নিষ্পেষণের দায় নারীর ওপর চাপানো হয় নাই। আসলে হিজাবের নীতি ঠিক আইনি ব্যাপার না। বরং আলাদা কিছু। আবার হিজাব নিতে জোর করা এবং স্বপ্রণোদিত হয়ে হিজাব নেয়ার ভেতর যে পার্থক্য তা নারীবাদীদের যুক্তিতে মানা হয় নাই। তাকে একাকার করা হয়েছে। পর্দাকে জোর করে চাপানো এবং একই অর্থে নারীর ওপর জোর করার সাথে স্কুলে পর্দা নিষিদ্ধ করার সম্পর্ক তালালের কাছে অনিবার্য না। তিনি আরও বলেন, বিভেদ সমতার অধীন--চিন্তার এই আদল আসলে সেইন্ট পলের চিন্তার সাথেই মিলে। কিসের আবার নারী পুরুষ? সবকিছুই তো যীশুরই অংশ।

নির্বিশেষ (ইউনিভার্সাল অর্থে) সমতা এবং বিশেষ (পার্টিকুলার অর্থে) বিভেদ আসলে সার্বিক ধারণা (জেনারেল অর্থে)। প্রথমটা গণমানুষ এবং দ্বিতীয়টা ব্যক্তি মানুষের বেলায় খাটে। চরম সিদ্ধ বলে কোন সার্বিক ধারণা নাই। কাজেই একাকার করা বা সার্বিকীকরণ বিশেষ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এবং অবশ্যই এটা একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপার। নানান কিসিমের যুক্তির প্রসঙ্গ ওঠানো যেতে পারে এক্ষেত্রে। তবে কোন যুক্তি প্রাসঙ্গিক আর কোনটা অপ্রাসঙ্গিক, কোনটা কোথায় খাটে--এসব নির্ধারণই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিষয়। যুক্তিশীলতা না বরং কি চাই কিভাবে চাই--সে অনুপাতে সাজানোই মুখ্য। ওযফের বক্তব্য এরকম সিদ্ধান্তকেই নির্দেশ করে বলে তালাল মনে করেন।

লাইসিতে তত্ত্বের যথার্থতা প্রমাণের জন্য প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকের সমতা বিধানের তেমন দরকার নাই। ব্যক্তিতন্ত্রের বিকাশই আসল লক্ষ্য। বিশেষ ব্যক্তিতন্ত্রই ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ, যার ভিত্তি ইওরোপীয় দর্শন প্রত্যক্ষবাদ (পজিটিভিজম) এবং মানবতাবাদের ভেতর নিহিত। খেয়াল করেন, স্টাসি কমিটির অনেক সদস্যই ১৯৯১ সালে গঠিত ‘লাইসিতে রিপাবলিক কমিটি’র সদস্য। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নিয়ে এই কমিটি গঠিত এবং এরা পরিস্কারভাবে পজিটিভিজম দ্বারা প্রভাবিত। কাজেই স্টাসি কমিটি নিরপেক্ষ না। তাদের কাছে ব্যক্তির যা কিছু তাই মানব জীবন। প্রজাতন্ত্রের কাজ ব্যক্তির জীবন রক্ষা করা। বিশেষ এই জীবনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাছে তুলে দেয়াই ‘আসল ত্যাগ’। রাষ্ট্রের কাছে যা অতিশয় ‘পবিত্র’। ‘পবিত্রতা’ রক্ষার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ভেতরই বিলীন হয় লিঙ্গীয় সমতার রহস্য। আধুনিক বিমূর্ত রাষ্ট্রের বসত গায়েবি জগতে। তাহলে তার চিহ্ন কোথায়? কোন ছবি বা মূর্তিতে এই অধরারে ধরা যায়? মূর্ত মানুষ কেমনে অধরা ঈশ্বরকে ধরে? চিহ্ন, নিশানা ইত্যাকার লক্ষণের মাধ্যমেই ব্যাপারটি ঘটে। রাষ্ট্র এভাবেই চিহ্ন নিশানার অর্থ নির্ধারণ করেই নাগরিকের মাঝে নিজেকে হাজির করে। বাম রাজনৈতিক, দার্শনিক এবং স্টাসি কমিশনের সদস্য রেজিজ ডেবরের মতে সামাজিক চুক্তি এমনই পবিত্র যে, কার্যত তা ঐশী বাণীর সমপর্যায়ের। বিভিন্ন সরকারি দলিল ঘাটলে বুঝা যায়, ফরাসি স্কুলগুলাকে এমনই পবিত্র স্থান ভাবা হয় যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতির মত পবিত্র আদর্শের শিক্ষা দেয়া হয়। মজার ব্যাপার হল, ফরাসি ধর্মীয় স্কুলের ব্যাপারে একথা বলা হয় না, বলা হয় শুধু সেকুলার সরকারি স্কুল সম্পর্কে। দার্শনিক অগাস্ট কোঁতের প্রত্যক্ষবাদী দর্শনে ধর্মকে কেবল একটা পরপারের ব্যাপার হিশাবে দেখা হয়। যা কি না আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার জন্য অদরকারি। প্রত্যক্ষবাদে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, সুশৃঙ্খল মানুষই অতীতে ধর্মীয় সব জঞ্জাল সরায়ে নিজেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। শৃঙ্খলা শিখবে কোথায়? অবশ্যই শৈশবে, স্কুলে। তাকে মানুষ (সাবজেক্ট) করবে প্রজাতন্ত্রের গণপাঠশালাগুলি। শিখাবে যুক্তি-বুদ্ধি-বাস্তবতা। তারা সবাই মানুষ হবে একই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের তলায়। প্রত্যক্ষবাদী এই বয়ানে বুঝা যায় যে, ব্যাপারটা মোটেও এমন নয় যে, স্বাধীনতা আর সাম্য ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। বরং তালালের কথায়, বিশেষ ধরনের ‘সাম্য’ এবং ‘স্বাধীনতা’ই লাইসিতেকে নিশ্চিত করে। আদতে লাইসিতে এমন এক অবস্থা যার ভেতর প্রজাতন্ত্র মানুষকে উত্তম নাগরিক হতে শিখায়। কি ভাল, কি মন্দ, কোনটা সুশাসন, সুশাসনের দায়িত্ব কার ... ইত্যাদি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল কোন বাস্তব জ্ঞানের ভিত্তিতে স্বাধীন ব্যক্তি ‘সত্যিকার মূর্ত সত্তা হবার মাধ্যমে জীবনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা নৈতিক দিকগুলা বেছে নেয়’। প্রকৃতাবস্থায় পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়ায় বাজার আর বিপণনই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। উদ্দেশ্য মুনাফা। এমন দুনিয়ায় পণ্যের বেসাতির বাইরে কিসের আবার ‘মুক্ত বাছাই’? তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে তা হল পুঁজিতন্ত্রের বাইরে কোনও লাইসিতে নাই। পুঁজিতন্ত্রের দ্বারা এবং বিমূর্ত রাষ্ট্রক্ষমতার দ্বারা চালিত হয় মানুষ। নাগরিকরা এমনই ‘স্বাধীন’ যে তারা পুঁজিতন্ত্র ও রাষ্ট্রের জোয়ালের অধীন। এই মানুষই উদারনৈতিক মানবতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার মুখ্য বিষয়। এই মানুষই মুক্তির ফানুসে বুঁদ হয়, যেই মুক্তির কল্পনা সবার জন্য বলে রাষ্ট্র নিয়ত প্রচার করে। মানুষ অনেক ভরসা করে নাগরিকতার নামে একে বরণ করে নেয়। এভাবেই মালাবদল হয় রাষ্ট্র এবং নাগরিকের। তারা উভয়েই চিহ্ন, নিশানার ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামোয় আটকা পড়ে। হিজাবকে সাধারণত দেখা হয় ভাই ও পিতাদের বাড়াবাড়ি ও চাপায়ে দেয়ার ব্যাপার হিশাবে, কিন্তু যারা স্বেচ্ছায় হিজাব বেছে নিয়েছে তাদের কথা আরও মজার। তাদের ক্ষেত্রে আর পারিবারিক প্রভাবের কথা ভাবা হয় না। তারা তো ধর্মান্ধ, কূয়ার ব্যাঙ, মৌলবাদী ও বেয়াদব। ইসলামী হিজাব আইনের সমর্থক ও সমালোচকরা একেকজন একেকভাবে বিষয়টাকে দেখেছেন। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা, হিজাববিরোধী আইনের পক্ষে বা বিপক্ষে যেদিকেই থাকুন না কেন, সবাই একই রাজনৈতিক ভাষা ও যুক্তি ব্যবহার করেছেন। তালাল বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা বুঝতে অক্ষম যে কিভাবে কোনও ধর্মবিশ্বাস ও গোত্র ঐতিহ্যকে কতটা গভীরভাবে তার অনুসারীরা লালন করে, এবং চর্চা করে। কোনও প্রজাতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও কিভাবে তাদের মূল্যবোধকে আঁকড়ে থাকে। দুই হাজার চার সালের নেকাব বিরোধী আইনের পরে মুসলিম নারীদের প্রতিবাদ মিছিলের স্লোগান ছিল ‘হিজাব হল মতাদর্শ, প্রতীক না’। বিখ্যাত মিশরি নাওয়াল আল সাদাবি এই মিছিলের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মিছিলকারীদের হাবভাবে মনে হয় হিজাব হল সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইসলামি প্রতিরোধের অংশ। তিনি আরও বলেন, এরা জিনস লিপস্টিক পরে কোকাকোলা খেতে খেতে স্লোগান দিচ্ছেন। বাহ কি মজা! এরা আসলে স্ববিরোধী মায়াবাদী (ফলস্ কনশাসনেস অর্থে)। এ প্রসঙ্গে তালাল মনে করেন সাদাবি এটা মানতে পারছে না, অতীন্দ্রিয় পরকালবাদী মুসলিম নারীরা কোন দাবিতে কেন কিভাবে মাঠে নামে। সাদাবির মত ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা মনে করে পরিধান-প্রসাধন বা নিজেকে সুন্দর রাখার চেষ্টা করা ধর্মকর্মের সাথে যায় না। তাহলে তাদের মতে, ধর্মকর্ম মানে শুধুই পরকালের চিন্তা করা, নয় কি? স্টাসি কমিশনের মতই সাদাবি মনে করেন, চিহ্ন, নিশানা বা প্রতীকই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মতাদর্শ না। যখন লিবারেল ধর্মনিরপেক্ষ কেউ এই চিহ্ন পাঠ করে, তখন তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিই আসল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। চিহ্নের অংশীদার ‘অপর’ যারা--তারা খারিজ হয়ে যায়। বাকি থাকে শুধু চিহ্ন বা প্রতীক। মরা, নিশ্চল, স্থির। নি®প্রাণ এই চিহ্নকে যেমন খুশি তেমন মানে দেয়া যায়। অর্থদাতা যদি লিবারেল হন তাহলে তো কথাই নাই। এসব অপরিণত বালিকারা জানে কি তারা কি করছে? তাদের স্ববিরোধী উপস্থিতি কি এটাই প্রমাণ করে না যে তারা আধুনিক হতে চায়, কিন্তু পারে না? ধর্মান্ধ গোঁড়া মুসলমান সমাজ কি তাদের আধুনিক হবার বাসনা ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে না? আমাদের কি উচিত না ওইসব মৌলবাদী কূয়ার ব্যাঙদের কাছ থেকে অসহায় বালিকাদের উদ্ধার করা? এসব প্রশ্ন আর তার জবাবই সেকুলার ব্যাখ্যা। যার ভেতর আধিপত্যের গোড়া। ধর্মীয় অপশক্তি যদি রাজনীতির বিকার ঘটায়--তালালের মতে, এই আশঙ্কা থেকে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা মনে করে, ধর্ম আসলে এক প্রতীক বা চিহ্ন ব্যবস্থা। (তবে এখানে মনে রাখা দরকার, তালাল চিহ্ন বা প্রতীক (‘সিম্বল’) শব্দটি এবং তার কারবার লাঁকার ‘প্রতীকী’ বা ‘সিম্বলিক’ অর্থে ব্যবহার করেন নাই। কানে একরকম শুনালেও তা ভিন্ন অর্থের। তালালের ব্যবহার করা ‘সিম্বল’ শব্দটি লাঁকানীয় ‘ইমাজিনারি’ বা হাওয়াইয়ের সাথেই অর্থগত ভাবে বেশি মিলে।) প্রতীকের যেমন খুশি তেমন ব্যাখ্যা দেয়ার মাধ্যমে ধর্মের হাত থেকে নিজের রাজনীতি রক্ষা করতে চায় রাষ্ট্র। ধর্ম যে রাজনীতির বাইরে সেই সীমা নির্ধারণ যেন সহজ হয়, তেমন সুবিধাজনক ব্যাখ্যা দেয়া যায় যদি ধর্মকে প্রতীকের বা চিহ্নের শৃঙ্খলায় বাঁধা যায়। চিহ্নের অর্থ নির্দিষ্ট করে সেকুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থা সর্বদাই ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করে। এমনকি ধর্মতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা প্রয়োগ করেও রাষ্ট্র একই কাজ করে। সর্বদা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলেও নিঃসন্দেহে তা যথেষ্ট বৈরীভাবাপন্ন। নজির; স্টাসি কমিশন প্রতিবেদন। যা কিছু ধর্মীয় তা থেকে নিজেকে না গুটায়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যার ভিতর দিয়ে ধর্মের সংজ্ঞা ও সীমানা নির্ণয় করছে ফরাসি সেকুলার রাষ্ট্র। তাই তালালের মতে, লাইসিতে আর যা-ই হোক, ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নকরণ না। ধর্মীয় চিহ্নের মানে বানানই শুধু না, বরং আইন করে তাকে স্থির করে দেয়ার মাধ্যমে প্রজাতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বারবার সামনে আনা হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে এসব হল আসলে ফরাসি--আর ওসব হচ্ছে সেসব--যার বিরুদ্ধে ফরাসি মূল্যবোধ চিরসংগ্রামে লিপ্ত, যা অনাধুনিক-বর্বর-বিভেদসৃষ্টিকারী ও সাম্য-মুক্তি-স্বাধীনতা বিরোধী। ফরাসি রাষ্ট্রের ইমানদার নাগরিকরাও একই খেলা খেলতে শিখছে। পাঠক, মনে রাখবেন হিজাব বিরোধী আইন ফরাসিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটেই তা পাশ হয়েছে। সবশেষে সেকুলারদের জন্য রাস্তা বাতলায়ে দেন তালাল; ধর্ম বর্ণ শ্রেণী সবকিছু মিলায়ে ফ্রান্সে এমন কোনও সামাজিক কাঠামো তৈরি হয় নাই যেখানে সকলে মিলেমিশে থাকবে। কাজেই মিল মহব্বতের যেই কাহিনী প্রজাতন্ত্র প্রচার করে, তা জাতীয়তাবাদী চেতনার অংশ, সামাজিক বাস্তবতা না। জাতিরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কখনও একই ধারাবহিকতায় প্রবাহিত হয় নাই, বা সেটা অপরিবর্তনীয় না। ইতিহাসে এমন নজির কম নাই। ধর্মকে সংজ্ঞায়ন প্রক্রিয়াও স্থির কোন ব্যাপার হতে পারে না। ইতিহাসের গতিপথে ধর্ম সমাজ ও সংস্কৃতির মত সেটাও পরিবর্তিত হতে পারে। শুধু এটুকু ভাবলেও, ধর্মকে ঠেকাতে হবে বা সেকুলার চিন্তাকে যেকোনও অবস্থায় রক্ষা করতে হবে--এই রকম কূপমণ্ডুকতার কবল থেকে কোনও সেকুলার নিজেকে বাঁচাতে পারবে কিম্বা ব্যক্তিগত বা সামাজিক বিপর্যয় এড়াতে পারবে। ছোট করে বললে, সবকিছুতে ‘ধর্মীয় আপদ’ না খুঁজে বিশেষ বিশেষ দাবি বা আশঙ্কাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটা সুরাহা হতে পারে।

শেষে এটা পরিষ্কার যে, তালাল সরাসরি কোনও রাজনৈতিক অবস্থান নেন নাই, যদিও বিদ্যায়তনিক প্রবন্ধে সেই সুযোগ কম। এক ধরনের মেরামতিমার্কা সমাধানের রাস্তা বাতলায়ে দিছেন। সেকুলারিজমকেও শেষমেষ তিনি খারিজ করেন নাই। শুধু ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টির অন্তর্নিহিত দিকগুলা ফর্শা করেছেন।

আমাদের কাজ হল, পর্দা নিষিদ্ধ করে মুসলিম নারীর জন্য করা আইনের সার কথা বুঝা। তাদের বেপর্দা করার আইনি বন্দোবস্তের কাসুন্দি ঘাঁটা। ব্যাপারটা নিছকই ফরাসি একটা আইন মাত্র না। কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনই এই আইনের ভেতর ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্রের সংকট, বৈশ্বিক রাজনীতি, ধর্ম (বিশেষ করে ইসলাম) সম্পর্কিত দিকগুলা উঠে আসে। সমকালীন রাষ্ট্রের চরিত্র ও কায়কারবার বুঝতে এইদিকগুলা বেজায় গুরুত্বপূর্ণ। এর আঁচ কতটা আমাদের গায়ে লাগে তার বিচারও বড় কর্তব্য।

লাইসিতে একটা ধারণা বা চিন্তা যার ভিত্তিতে সরকারি নীতিমালা- আইন- সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফ্রান্সে। সরাসরি এটা কোন আইন না। কিন্তু আইনের জনক। রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্ম ছিল বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সে সংখাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম। বিপ্লবে ফরাসি জনগণ রাজতন্ত্রকে উৎখাত করেছিল। যদিও চার্চ ও যাজকতন্ত্রকে উৎখাত করা বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু তা পার পেয়ে যায়। বিপ্লবী সরকার তখন চার্চের ব্যাপক সম্পত্তি নিলামে দেয়। সরকারকে মেনে নেয়ার জন্য যাজকদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। শুধু তাই না, বরং পুনর্গঠনের মাধ্যমে চার্চকে রাষ্ট্রের অধীনে আনার চেষ্টা করে। এই হল খুব সংক্ষেপে প্রজাতন্ত্র ও চার্চের ক্ষমতা দ্বন্দ্বের ইতিহাসের প্রারম্ভিক দশা। উনিশশ পাঁচ সালে রাষ্ট্র ও চার্চের পাকাপাকি তালাকনামা স্বাক্ষরিত হয়। তারও আগে আঠারশ আশির দশকে স্কুলে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা (জুল ফেরি আইন) চালু হয়। চার্চের সাথে ক্ষমতার চরম দ্বন্দ্ব, নতুন বুর্জোয়া শ্রেণীর আবির্ভাব, ক্ষয়িষ্ণু রাজতন্ত্র এবং এরই ধারাবাহিকতায় ফরাসি বিপ্লবের কাহিনী আমাদের কমবেশি জানা। ফ্রান্সের সর্বশেষ রাজা ষোড়শ লুইয়ের সময়কালে ফরাসি রাজ্য তিন এস্টেটে বিভক্ত ছিল। মূলত চার্চ এবং যাজকতন্ত্র ছিল প্রথম ভাগে। দ্বিতীয় অংশে ছিল অভিজাত সম্প্রদায়। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল তৃতীয় অংশে--উঠতি বুর্জোয়া ব্যবসায়ী মেহনতি এবং কৃষক ছিল এর অন্তর্গত। বিপ্লবের কিছুকাল আগ থেকে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। রাজার নজর এদিকে তেমন ছিল না। বরং তিনি যাজক এবং অভিজাত সম্প্রদায়কে খাজনামুক্ত করেন। সকল খাজনার বোঝা চাপান বুর্জোয়া শ্রমিক ও কৃষকদের ওপর। সাথে ছিল বিদেশে সৈন্য পাঠানো এবং যুদ্ধের ভার। এসময় রাজা আমেরিকায় সৈন্য পাঠান। সেখানে বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে আমেরিকান প্রজাতান্ত্রিকরা জয়লাভ করে। আমেরিকার অভিজ্ঞতা হতে অনেক ফরাসিরা ব্যবহারিক অর্থে বোঝে প্রজাতন্ত্র রাজতন্ত্রের চেয়ে শ্রেয়। তাছাড়া রাজতন্ত্রের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া আধুনিক দর্শন এর ভেতরেই ফ্রান্সে বিকশিত হচ্ছিল। এসব বাস্তব আর্থসামাজিক কারণে রাজা প্রজার দূরত্ব বেড়েই চলছিল। রাজার ক্ষমতার সাথেই সংযুক্ত ছিল চার্চ। যাজকরা মূলত ছিল অভিজাত শ্রেণীর। সতেরশ উনানব্বই সালে ফ্রান্সে একশ পঁয়ত্রিশ জন বিশপ ছিলেন। এর ভেতর শুধু একজন বিশপ সাধারণ জনগণের ভেতর থেকে এসেছেন। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, চার্চ এবং যাজকতন্ত্র জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। স্বভাবতই তাদের বিরুদ্ধে জনরোষ তীব্র হয়ে ওঠে। রাজতন্ত্রের পতনের পর এমনিতেই অভিজাততন্ত্র বিলুপ্ত হয়। কিন্তু যেহেতু ধর্ম আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তিমানুষের বিশ্বাসের ব্যাপারও বটে, সেহেতু তাকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত করা হয়। ক্ষমতাহীন করা হয়। রাজতন্ত্রের সময় তিন এস্টেটে বিভক্ত রাজ্য পরে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর দুই ভাগে ভাগ হয়: লোকালয় এবং আপনালয়। এটাই বুর্জোয়া ব্যবস্থা, যার লক্ষ্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখভাল করা, চার্চ এবং ধর্মের স্থান ও মর্যাদার গুণগত পরিবর্তন এর ভেতরেই ঘটে। সবাই একমত হবেন যে, ফরাসি এই আদল পৃথিবীর সর্বত্র এক হতে পারে না। এই দ্বন্দ্ব মূলত রাজতন্ত্র এবং ব্যক্তিতন্ত্রের, যার আলোকে ধর্মনিরপেক্ষতা গজিয়ে উঠেছে বাস্তব কারণে, ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সের বিশেষ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ফসল। যার ফলাফল খাটো করে দেখার উপায় নাই। যদিও তা সর্বজনীন না। ফরাসি বিপ্লবের বাস্তবতায় রাষ্ট্র-রাজনীতি ও খ্রিস্টান ধর্মের সম্পর্ক বিশেষ ধরনের বাস্তবতা তৈরি করে। তবে উপনিবেশের ধর্ম ইসলামের বেলায় এই বাস্তবতা মিলে না। বিপ্লবের বাস্তবতাতেও চার্চ ও যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই অসম্পূর্ণ ছিল। ধর্মীয় ভাব চিন্তা-আকুতি না বুঝে তাকে শুধু নিষ্পেষণের হাতিয়ার আর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার বলে ধরে নেয়া হয়েছে। তাই তাকে আপনালয়ে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। এই ভুলের চারা এতদিনে বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ধর্মকে না বুঝলেও বুর্জোয়া ব্যক্তির আকুতি ও বাসনার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে আলোজ্বালাতনের (অ্যানলাইটেনমেন্ট) দর্শনে। উপনিবেশের হিজাবে ঢাকা মুসলিম নারীকে দেখে এই ব্যক্তি (পুরুষ) চরম সংকটে পড়ে। ফ্রাঞ্জ ফানোর চিন্তায় যা ধরা পড়েছে। বিজ্ঞ পাঠক তার ‘ডাইং কলোনিয়ালিজম’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। প্রদর্শনকামী ইওরোপীয় পুরুষ তার বিকার চরিতার্থ করতে চায়। হিজাবের আড়ালের মুখটা-শরীরটা কি রকম হবে, কোকের বোতল না পেপসি--এই নিয়ে কল্পনার কোন শেষ নাই তার। তাকে ভোগ করার নতুন ছক কষতে থাকে। হাজার হোক এই হিশাব তো অতি পরিচিত বোরিং ইওরোপীয় নারীদের সাথে আবার যায় না। তাই তা আনকোরা নতুন। এসব নানা নতুন অভিজ্ঞতা তাকে পাগল করে দেয় ঝাঁপিয়ে পড়তে। ফানো’র কাছে এই বিকার শুধুমাত্র পুরুষ-নারী সম্পর্ক না বরং কলোনি সমাজের প্রতি ইওরোপীয়দের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। কলোনি মুক্ত কিন্তু হিজাবও আছে আর ইওরোপ আর তার পুরুষেরাও দেদারছে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে নতুন উপনিবেশ দুনিয়ায়। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাথে নানারকম ধর্মনিরপেক্ষ আইন জারি সরাসরি সম্পৃক্ত। আঠারশ সত্তর সালে ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে পরাজয়ের পর ফ্রান্সে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সময়ে নিত্য নতুন প্রজাতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিস্তার লাভ করে। ক্যাথলিক চার্চের নীতি নিয়মের বিকল্প অনুসন্ধানে সেই সময়ে ফ্রান্সে যার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান এবং নাগরিক তৈরি করা ছিল রাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। অবশ্যই রাষ্ট্র নীতির কানুন মেনে। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের নাগরিক তৈরি করা বহুত জটিল ব্যাপার বটে। সমাধান বাতলালেন প্রজাতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী জুল ফেরি। সেসময় শিক্ষাব্যবস্থায় চার্চের প্রভাব এবং কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল। শিক্ষা নিয়ে ফরাসি জাতির মাথাব্যথার কমতি ছিল না। পাঠক, আপনারা এর নজির পাবেন, যদি ফরাসি রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের অন্যতম প্রচারক জাঁ জাক রুশোর ‘এমিল’ কিতাবখানি পড়েন। জনগণের তরফ থেকেও চার্চের যাজক তন্ত্রের শিকড় উপড়ে ফেলার প্রচণ্ড চাপ ছিল। এই পটভূমিতেই জুল ফেরি আইন বলবৎ হয়। যার মোদ্দা কথা হল, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা কার্যক্রমের অধীন গণপাঠশালায় ধর্মভিত্তিক শিক্ষাকে বাতিল করা, যেন প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধের বিকাশ ঘটায়ে ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক তৈরি করা যায়, যারা রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করবে। শুধু তাই না, শিল্প বিপ্লবের যুগ সন্ধিতে বুর্জোয়া মন মানসিকতা তৈরি এবং শিল্প উৎপাদনের অনুকূলে সুবিধা মত মজুর শ্রেণী তৈরির রাস্তাও খুলে যায়। এই সত্য বুঝলে আমরা ওয়াকিবহাল হব, কেন শুধু ফ্রান্সে না বরং সকল রাষ্ট্রের জন্য গণপাঠশালা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

কেন এখনও এধরনের চিন্তা প্রয়োগ করার পরিকল্পনা স্কুলকে কেন্দ্র করে নেয়া হয়। গণপাঠশালা ফরাসি লোকালয়ে অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের মনে রাখা দরকার, এরই মধ্যে বুর্জোয়া ব্যবস্থার পত্তন হয়েছে ইওরোপে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফলে একটা শক্তিশালী লোকালয় দরকার যেখানে ব্যক্তি নানা সামাজিক অর্থনৈতিক কায়কারবারের মাধ্যমে তার স্বার্থকে টিকিয়ে রাখবে-বিকশিত করবে। জাতিরাষ্ট্রের জন্য তাই নিজ দেশের লোকালয়কে শক্তিশালী করা, তাকে রাষ্ট্রীয় সংহতির বাইরে অন্য কোন রাজনৈতিক ভাবাদর্শ থেকে মুক্ত রাখা, সর্বোপরি রাষ্ট্রের নীতি মূল্যবোধ আদর্শের শক্তিশালী কেন্দ্র হিশাবে গড়ে তোলা প্রধান কাজ। কারণ এর মধ্যে জাতিরাষ্ট্র ও বুর্জোয়া নাগরিক মেলবন্ধন সুদৃঢ় ও স্থায়ী হয়। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, পুঁজিতান্ত্রিক বুর্জোয়া ব্যবস্থা ও ধর্মনিরপেক্ষতা পরস্পরকে পুষ্ট করে। যদি ধর্ম বা মোল্লাতন্ত্র এই লোকালয়, রাজনীতি, রাষ্ট্রকে আচ্ছন্ন করে রাখে তাহলে বিপদেরই কথা। প্রজাতন্ত্র এটা মানবে কিভাবে? প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধ সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা; যাকে ধরে নেয়া হয় ধর্মীয় মূল্যবোধ বিরোধী আদর্শ হিশাবে। কাজেই রাজনৈতিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।

লাইসিতে অনুসারীরা বা যেকোন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা মনে করে, ধর্মনিরপেক্ষ মানে তো ধর্মহীনতা নয়, বরং ধর্মকে তা আরও নিশ্চিত করে। ধর্ম চর্চা, বিশ্বাস মত প্রকাশের স্বাধীনতার অংশ। অবশ্যই স্বাধীন নাগরিক মাত্রই মুক্তভাবে ধর্মকর্ম করতে পারবে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার ভেতরে। তবে কথা আছে, সেটা হতে হবে ব্যক্তিগত চৌহদ্দির ভেতরে। রাষ্ট্র-রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করে তাকে ব্যক্তিগত আলয়ে চালান করার মাধ্যমে নাগরিকদের মুক্ত করা সম্ভব। এমনকি ধর্মীয় চর্চার মুক্ত প্রকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব। শুধু তাই না, ধর্মভিত্তিক বৈষম্যের বিষদাঁত ভেঙে ফেলা সম্ভব। যদি রাষ্ট্রের কেন্দ্রে কোন ধর্ম থাকে, তাহলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের যে কি করুণ দশা হয় তা বলাই বাহুল্য। কাজেই ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র দাওয়াই। যা যুগের বুর্জোয়া চাহিদাকেও তুষ্ট করে। সমকালীন ফ্রান্সের ঘটনাবলীর আলোকে লাইসিতের অন্তর্নিহিত বিরোধিতা বিচারের বিবরণ খুব সংক্ষেপে এখানে পেশ করব। সে প্রসঙ্গে যাবার সাথে সাথে স্টাসি দলিলের কিছু কথা বলে রাখা ভাল। দলিলটির বিশ্লেষণ আমাদের আলোচনা এগিয়ে নেয়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সাবেক ফরাসি রাষ্ট্রপতি জাক শিরাক প্রজাতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী বার্নার্ড স্টাসিকে প্রধান করে কুড়ি সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির এই দলিলের ভিত্তিতেই পরবর্তীতে স্কুল ও লোকালয়কে লক্ষ্য করে পর্দা বিরোধী আইন তৈরি হয়। ওয়াকিবহাল অধ্যাপক তালালের বরাতে এর অনেক দিক সম্পর্কে আমরা এতক্ষণ আলাপ করলাম। দলিলের মূল যুক্তি ছিল, ‘সরব ধর্মীয় চিহ্ন’র সমস্যা। যে সমস্ত চিহ্ন বিশিষ্ট পোশাক-আশাক বা অলংকার ধর্মীয় পরিচয়কে প্রকাশ করে, তা পরে জনসমক্ষে আসলে প্রজাতন্ত্রের মূল্যহানি হয়, বিশ্বস্ত নাগরিকরা নিজেদের আপন ভূমে পরবাসী মনে করে। এসব যারা পরে তারাও নিজেদের আলাদা ভাবে, ফলে বৃহত্তর ফরাসি লোকালয়ের অংশ হতে তারা পারে না। মজার কথা, পবিত্র কোরানে চিহ্ন বিশিষ্ট পোশাক পরিধানের আবশ্যিক কোন নিয়ম নাই, ধর্মীয় চিহ্নের কোন সংজ্ঞাও নাই। হিজাব বা পর্দা মোটেও ইসলামি চিহ্ন না। বরং ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা বা আদর্শ। অথচ দলিলে এর কোন উল্লেখই নাই। পক্ষান্তরে ব্যবহারিক জগতে ক্রুশ পরাটা তেমন কোন ঘটনা না। ফ্রান্সে ক্রুশ পরার জন্য স্কুলে কাউকে বহিষ্কার করা হয়েছে এমনটা শুনি নাই। ক্রুশের লকেট তো জনসমাদৃত ফ্যাশনের একটা অংশ। তাও আবার জনসমাদৃত শুধু না, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ-আদৃত। এ থেকে বুঝা যায়, দলিলের বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত অবশ্যই সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক। রাষ্ট্র লাইসিতে ব্যবস্থায় ধর্মীয় বক্তব্য দান থেকে নিজেকে বিরত রাখে। কিন্তু দলিলে সরাসরি ধর্মীয় চিহ্নের অর্থ দেয়া হচ্ছে। কাজেই খোদ দলিলের সিদ্ধান্ত একটা ধর্মীয় ফতোয়া বই কিছু না। মজার ব্যাপার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জর্মানি, ইতালিতে ক্রুশকে ধর্মীয় চিহ্ন বলে সরকারি স্কুলে নিষিদ্ধ করার জন্য মামলা করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার মূল আদর্শের সাথে বিরোধী না বলে তা খারিজ হয়ে যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এখন ধর্মনিরপেক্ষ বলে কিছু নাই। আবার খ্রিস্টান বলেও কিছু নাই। আছে ধর্মনিরপেক্ষ খ্রিস্টান ধর্ম। তাই ক্রুশ এখন জনসংস্কৃতির বিষয়। ধর্মের বিষয় না। দলিলে ধর্মীয় বহুত্বের প্রতি অপরিসীম দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, সরব চিহ্নের কথা বলে, তাকে একেবারে অস্বীকার করা হয়েছে। এই ব্যতিক্রমই আসলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রমাণ। আবার ধর্মীয় সমাজের ব্যাপারেও দলিলে প্রবল আপত্তি লক্ষ করা যায়। আইনি পন্থায় এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সায় দিয়েছেন দলিলটির রচয়িতা ফরাসি বুদ্ধিজীবীরা। ধর্মীয় সমাজের সীমা বেঁধে দিয়ে এই নিয়ন্ত্রণ কায়েম হোক এটাই তাদের ইচ্ছা। কারণ ধর্মীয় সমাজ তাদের দৃষ্টিতে লোকসমাজ না। মুসলিম ধর্মীয় সমাজই নাকি মুসলিম অবোধ বালিকাদের ওপর জবরদস্তি করে। খেয়াল করলে বুঝা যায়, ‘রাজনৈতিক ইসলামের ভীতি’ এধরনের উসিলার পেছনে সক্রিয়। কিন্তু এর অন্যতম মূল লক্ষ্য, নাগরিকের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার প্রস্তাবনার কি হল তাহলে? নাগরিক- ধর্ম- ধর্মীয় সমাজ- রাষ্ট্র- লোকালয়ের আন্তঃসম্পর্ক তাদের কাছে খুবই অপরিষ্কার। কিন্তু তারপরও সিদ্ধান্তের বেলায় তারা একেবারে টনটনে। স্টাসি কমিশন গঠিত হয়েছে যাদের নিয়ে তাদের অন্যতম হলেন, রেজিস ডেবরে। (কিউবান আদলে ‘বিপ্লব রফতানি’ করার তত্ত্বের বিখ্যাত প্রচারক)। পর্দা বিরোধী আইনের সপক্ষে বামপন্থী ও সমাজবাদীদের অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত। আবার দলিলে এক বিশেষ যুক্তি হল, নরনারীর সমতা বিধান বা নারী মুক্তির প্রশ্ন। ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ মরক্কোর এক মুসলিম নারী এরই মধ্যে হিজাব নেয়ার কারণে ফরাসি নাগরিকত্ব লাভে বঞ্চিত হয়েছেন। কাজেই ফরাসি স্বামীর পাশে ফরাসি ভূমি তার জন্য মেলে নাই। এধরনের ঘটনা এখন ঘটছে। যার যুক্তির উৎস স্টাসি দলিলে পাওয়া যায়। এমনকি ভারতের একটি শহরের কলেজেও ধর্মীয় চিহ্নের বহন ও প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে নিয়ম তৈরি করে হিজাবধারীদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বামপন্থা আর নারীবাদের (বিশেষ অর্থে) ভাব স্টাসি দলিলের ওপর অপরিসীম প্রভাব যুগিয়েছে। হয় ধর্ম ছাড় না হয় ফ্রান্স ছাড়--এই দুইয়ের কোনটাকে বেছে নিলে ফ্রান্সে একজন মুসলিম নারীর মুক্তিতে ভক্তি সম্ভব--সেটাই নারীবাদীদের কাছে আমার প্রশ্ন।

লাইসিতে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, রাজা ও চার্চের সাথে বিপ্লবীদের দ্বন্দ্ব ছিল মূলত ক্ষমতার। রাজার পতন এবং চার্চের ক্ষমতা হ্রাসের কালপর্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম হিশাবে খ্রিস্টধর্ম অটুট ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম হিশাবে তা শুধু টিকেই যায় নাই, বরং একধরনের নিধর্মীকরণ প্রক্রিয়া খ্রিস্টান চিন্তা রাষ্ট্র চিন্তার অন্তর্গত হয়ে যায়। হালের বড় বড় ভাবুক দার্শনিকরা অন্তত এ বিষয়ে একমত যে, পশ্চিমা সেকুলার ভাবের কেন্দ্রে বাস করে খ্রিস্টান চিন্তা। পুঁজিতন্ত্রের আবির্ভাবের সাথে তাকে শুধু মাথার মুকুটটা খুলে ফেলতে হয়েছে। একঘরে দুই পীরের বসত কি সম্ভব? দুই ভাই--বুর্জোয়া তন্ত্র, খ্রিস্টতন্ত্র। বাবা রাজতন্ত্রের মরার পর ঝামেলা বাড়ানোর চেয়ে আলাদা করে বাস শুরু করে তারা। কিন্তু বাড়িটা একই রইল। এধরনের একটা লঘু উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাপারটা আমরা বুঝার চেষ্টা করতে পারি। সর্বোপরি তাদের বিবাদটা তাদের ঘরেরই বিবাদ। কিন্তু হিজাব পরা ওরা কারা? মুসলিমরা উপনিবেশ থেকে যখন দলে দলে ফ্রান্সে অভিবাসন শুরু করল, আপদের শুরু তখনই। সেই আপদ বিপদে পরিণত হল, এগারই সেপ্টেম্বর দুই হাজার এক ইসায়ীতে। ভাই ভাই বিবাদের মীমাংসা না হয় এক টেবিলে সম্ভব। কিন্তু গোলাম মুনিবের বিবাদের ফ্যাসাদের সুরাহা হবে কিভাবে? আচ্ছা ঠিক আছে, ধরেন, নয় এগার বলে ইতিহাসে কিছু ঘটে নাই। এমনকি ইসলাম বলেও এই সৌর জগতে কিছু নাই, তারপরও বলা যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মের বিরোধ আবেগী, কাল্পনিক আর স্বার্থের। ধর্মের গভীর পর্যালোচনা মানুষ আর বিশ্বাসের সম্পর্কের অনুধাবনের মধ্য দিয়ে না গিয়ে এমনকি আধুনিক মানুষ যেই পদ্ধতিতে ধর্ম বিচার করে সেই যুক্তিবুদ্ধির বুঝ পরিষ্কার না করে জোরজবরদস্তি আর কুতর্কই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে এক্ষেত্রে। দুতরফেই এ লক্ষণ প্রধান। তাই সমাধান যেভাবে হওয়া উচিত সেই পারস্পরিক সম্পর্কের সত্যের জায়গায় না হয়ে, হচ্ছে নানা উদ্ভট কাল্পনিক উপায়ে, সহিংসতায় ও বলপ্রয়োগে। ধর্মনিরপেক্ষতা আর চার্চের বেলায় এ সত্য খাটে। এখন ইসলামের সাথে বিরোধ একই জায়গায় টেনে আনার চেষ্টা করা হলেও অতিরিক্ত কিছু নতুন অনুষঙ্গ তৈরি হয়। এই ইসলাম হল, ইওরোপীয়দের উপনিবেশিক ‘অপর’ (সংস্কৃতিগত অপর অর্থে)। ধর্মনিরপেক্ষতা বুঝতে পারে না, কোনও ধর্মের স্বরূপ যদি রাজনৈতিক হয়, তাহলে রাজনীতি থেকে তাকে বাদ দেয়ার মানে ধর্মচ্যুতি ঘটানো। ধর্মকে নিছকই ব্যক্তিগত ব্যাপার বললে সবকিছু চুকেবুকে যায় না। ইতিহাসে এমন নজির নাই। এই প্রচেষ্টা নতুন কিসিমের সাম্প্রদায়িকতা এবং বর্ণবাদ। নাজিরা ইহুদি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদি সমস্যার সমাধান করতে গিয়েছিল, এখন ফরাসিরা করছে আইনের ভেতর। কার্ল মার্কস, কার্ল স্মিট সাফ সাফ দেখিয়েছেন, আধুনিক রাষ্ট্রের কাঠামো ধর্মতাত্ত্বিক--তো সেটা ধর্মনিরপেক্ষ হোক বা গণতান্ত্রিকই হোক নানা লক্ষণ বিচারে এতটুকু পরিষ্কার যে, ফ্রান্সে লাইসিতের সাথে চার্চের সম্পর্ক আর ইসলামের সাথে তার সম্পর্কের জায়গা এক না। সকল ধর্ম একই সাধারণ কোন নিয়ম বা ফর্মুলায় চলে না। অনেকেই বলেন, ফ্রান্সে ধর্মনিরপেক্ষতার পচন শুরু হয়েছে হিজাব বিরোধী আইনের মাধ্যমে। ফ্রান্স পাগল উন্মাদ হতে শুরু করেছে। ইনারাই আবার ধর্মনিরপেক্ষতার ভেতরে নতুন পুরাতনে ভাগ করেন। বিভিন্ন দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ধরনের ভেতর ফারাক করেন। আসলে এর কারণ গোপন সেকুলার আশনাই। বিভিন্ন দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার যে পার্থক্য তা শুধুই চেহারার, হাড়-মাংস একই। এই হাড়-মাংস রক্ত হল ধর্ম কি তা বুঝতে ভুল করা। অথবা, খুব বুঝেছি এরকম ভান করা, তাই সাবেক ফরাসিরা চার্চ আর ধর্ম ভাব বা পরমার্থিক ভাবকে গুলিয়ে এক করে দেখেছিল। সমাধান দিয়েছে অন্দরে চালান করে। হালের ফরাসিরাও ধর্মের চিহ্ন আর ধর্মের ভাবকে এক করে গুলিয়ে দেখা শুরু করেছে। সমাধান? পশ্চিমা সমাধান? চিহ্ন নিষিদ্ধ। দুই প্রমাদের মর্ম এক।

আমাদের জন্য দরকারি বিষয় হল এটা বুঝা যে, ধর্ম মানুষের সম্পর্ক বুঝতে গড়িমসি করা, আলসেমি করা, যেমন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বৈশিষ্ট্য ঠিক তেমনই ধর্মতন্ত্রীরা এ ব্যাপারে উদাসীন। ফলে তারা একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে এটাও পরিষ্কার যে, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আমাদের দেশেও একটা বড় ধরনের মশকরা ঘটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এখানেও স্কুলে ধর্মীয় পোশাকের বাধ্যবাধকতা নিয়ে জোর করাকে নিষিদ্ধ করে সম্প্রতি আদালত স্বপ্রণোদিত আদেশ জারি করেছে। শিক্ষানীতিতে কওমী মাদরাসা বিরোধী ঘৃণায় উসকানি দেয়া হয়েছে। এসবের মাধ্যমে কারা কি অর্জন করতে চায় তা আমাদের কাছে পরিষ্কার। ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতন্ত্রের সম্পর্ক কি? সাম্প্রদায়িকতা নির্র্মূলে ধর্মনিরপেক্ষতাই কি সবচাইতে বড় এবং একমাত্র আদর্শ? সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এবং আধিপত্যের সাথে নারীবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পর্ক কি? ধর্ম কি, ধর্মতন্ত্র কি এবং উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক কি? বৈশ্বিক রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা কি? ধর্ম বিশ্বাসের দার্শনিক পর্যালোচনা কিভাবে সম্ভব? আধুনিকতা ও যুক্তিবাদীতার মর্ম কি? এসব প্রশ্নের আরও বিস্তারিত আলোচনা খুবই দরকার। কাজেই সবাইকে এ আলোচনা ও তর্কবিতর্ক এগিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানাই। তবে সমস্যা হল, আমাদের মধ্যে যারা ইওরোপীয়দের নকল করে প্যান্টের তলায় আন্ডারওয়্যার পরে খুব পুলক অনুভব করে, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি ও চিন্তা-ভাবনাকে ধ্যান জ্ঞান করে তাদের প্রতি আস্থা সরিয়ে ফেলা উত্তম। বলাই বাহুল্য এদের মধ্যে সেকুলার বামরাও যেমন আছে তেমনই ধর্মতন্ত্রীদের সংখ্যাও কম না। দরকার পর্দা-বেপর্দার ফারাক পরিষ্কার করে নতুন চিন্তা ও তৎপরতার রাস্তা তৈয়ার করা।
সূত্রঃ চিন্তা

1 comments:

Post a Comment