Wednesday, September 8, 2010

ঈদ উৎসবের গোড়ার কথা

0 comments

ঈদ মানেই আনন্দ আর আনন্দ। মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দঘন উৎসব। এই আনন্দ ছোট-বড়, শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ সবারই হৃদয়ের গহীনে মহামিলনের এক অব্যক্ত সুরের মূর্ছনা জাগিয়ে তোলে। পবিত্র এই উৎসবটির শুরু হয়েছিল আজ থেকে ১১৮২ বছর আগে। মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) মদিনা মনোয়ারায় হিজরত করে এসে লক্ষ করলেন, মুসলমানদের জন্য কোনো উৎসব পালনের রীতি চালু হয়নি। এরপরই হিজরীর দেড় বছর পর মুসলমানরা প্রথম একটি বার্ষিক আনন্দ উৎসব পালনের নির্দেশ পায়, সেটিই হচ্ছে মুসলমানদের জন্য মহাআনন্দ আর মহামিলনের দিন_ পবিত্র ঈদুল ফিতর। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ রমজান তথা ১৭ মার্চ সংঘটিত হয়েছিল বদরের যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধের ঐতিহাসিক বিজয়ের ১৩ দিনের মাথায় অর্থাৎ ৩০ রমজান প্রিয়নবী (সা.) ঘোষণা দিলেন পবিত্র ঈদুল ফিতর পালনের। এই ঘোষণার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ঈদ উদযাপনের আনন্দ জোয়ার প্রবাহিত হলো ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১লা শাওয়াল, ৩১ মার্চ। ঈদুল ফিতরের অর্থ হচ্ছে সিয়াম ভাঙার আনন্দ উৎসব। প্রথম ঈদের দিনে প্রিয়নবী (সা.)-এর ইমামতিতে আদায় করা হয়েছিল দু'রাকাত ওয়াজিব নামাজ। এরপর থেকেই প্রতিবছরের ১লা শাওয়াল পালিত হয়ে আসছে মুসলমানদের মহা আনন্দের সওগাত পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ তো গেলো পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুরুর কথা। কিন্তু সে সময় কিভাবে পালিত হতো ঈদ? বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত খুঁজে জানা যায়, প্রিয়নবী (সা.)-এর আমলে ঈদের দিনে ব্যবস্থা করা হতো নানা ধরনের আমোদ-প্রমোদ আর আনন্দ উৎসবের। হাব্শীরা বিভিন্ন ধরনের তলোয়ারের কসরত প্রদর্শন করত। ধনীরা ফিতরা ছাড়াও দরিদ্রদের মধ্যে প্রচুর দান-খয়রাত করত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সজ্জিত হতো নানা রকমের রং-বেরংয়ের সুন্দর সুন্দর পোশাকে। তারা কবিতা পাঠ করত আর আনন্দের সুমধুর তারানা গাইতো। প্রিয়নবী (সা.) স্বয়ং সবাইকে ঈদের আমোদ-প্রমোদে উৎসাহিত করতেন। একটি হাদিসে আছে, তিনি তার স্ত্রীসহ ঈদের দিন হাব্শীদের অস্ত্র চালনা অবলোকন করতেন। ঘরে রান্না করা হতো এবং প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠানো হতো সুস্বাদু উপাদেয় খাবার। মেহমানদের আপ্যায়নের মাধ্যমে ঈদের খুশি বিনিময় করত একে-অপরের সঙ্গে। মহানবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে ঘর থেকে বের হতেন কয়েকটি কোরমা মুখে দিয়ে। এভাবে শত শত বছর পার হয়ে গেছে। মুসলমানদের ঘরে প্রতিবছর ঈদ এসেছে নিত্যনতুন খুশির বার্তা নিয়ে। পরিবর্তিত হয়েছে উৎসবের ধারা। যোগ হয়েছে নানারকম আনন্দ-অনুষ্ঠান। আজ থেকে তিন-চারশ বছর আগের ঈদ পালনের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, তৎকালে বর্তমান বাংলাদেশের একমাত্র ঢাকা নগরীতে জাঁকজমকের সঙ্গে ঈদ পালন করা হতো। অন্যান্য অঞ্চলে তা ছিল অত্যন্ত সাদামাঠা। ঈদ ছিল তখন ধনাঢ্য বিত্তবান ও নওয়াব শ্রেণীর ব্যক্তিদেরই আনন্দ উৎসব। আর ঢাকা ছিল ধনাঢ্য, বিত্তবান ও নওয়াবদেরই নগরী। ১৮৪৭ সালের পূর্বে ঢাকা ছিল পূর্ববঙ্গের প্রধান ও মুঘল শহর। তাই এখানে থাকতেন নওয়াব ও অন্যান্য মুসলমান ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। ফলে ঈদের আনন্দ উৎসব এখানেই পেতো যথার্থতা। ১৬১০ সালে এদেশে রাজত্ব কায়েম করেছিল মুঘলরা। ঢাকা ছিল তাদের রাজধানী। ঈদের চাঁদ দেখা গেলে বেজে উঠত শাহী তুর্ণ, আতশবাজির মতো গোলাগুলি ছোড়া হতো আকাশে, ভারী কামান দাগা হতো। ঈদের নামাজ পড়ার জন্য শহরের বাইরে এক বিরাট উন্মুক্ত জায়গা নির্ধারণ করা হতো যাকে বলা হতো ঈদগাহ। এরকম একটি ঈদগাহ এখনো আছে ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকায় যা বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণ করছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। উনিশ শতকের শেষ দিকে শহরের মুসলমানরা ঈদের নামাজ পড়ত ঈদগাহে এবং ঈদগাহের চতুর্দিক জুড়ে আয়োজন করা হতো বিশাল মেলার। মেলায় বাঁশের তৈরি খাঞ্চা, ডালা, কাঠের খেলনা, ময়দা ও ছানার খাবারের বাহারি দোকান বসত। কাবুলীদের নাচ হতো বিকেল বেলা। ঈদের দিনে ছেলে-মেয়েরা রং-বেরংয়ের সুন্দর সুন্দর নতুন জামাকাপড় পরত। অষ্টাদশ শতক থেকেই ঈদুল ফিতর ছিল আনন্দ-ফূর্তি ও সকল মানুষের জন্য নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ পরার একটি দিন। সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে সবাই শোভাযাত্রা সহকারে ঈদগাহে যেতো। প্রতি ঈদের নামাজ পড়ানো ও কবর জেয়ারতের জন্য দেশের বাইরে থেকে আলেম-মাওলানা আনা হতো। কোন ঈদে কোন শহরে বা গ্রামে কোন আলেম এলেন এটা একটা মান-সম্মানের বিষয় ছিল। রমজান মাসেই আফগানিস্তান থেকে একদল মাওলানা আসতেন। কথা বলতেন ইলিমিলি-ঝিলিমিলি ভাষায়। তাদের ভাষা বুঝতে না পারলেও মানুষ তাদের খুব সম্মান দেখাতো, টাকা-পয়সা দিতো। এসব আলেম-মাওলানারা মানুষকে অনেক কেরামতিও দেখাতেন। যেমন আঙ্গুর-বেদানার হঠাৎ করে ভক্তদের মধ্যে বিতরণ, জি্বন হাজির করা ইত্যাদি। এর মধ্যে কি রহস্য তা বেয়াদবীর ভয়েও কেউ জিজ্ঞাসা করতো না। তাদের দিয়ে কবর জেয়ারত করাতে পারা খুব সওয়াবের কাজ বলে সবাই মনে করত। ঈদের নামাজের পর প্রতি বাড়িতে সেমাই, খিচুড়ি খাওয়া হতো। ঈদুল ফিতরের প্রধান আকর্ষণ ছিল দুধ-সেমাই। ঈদুল ফিতরে দুধ-সেমাইয়ের প্রাধান্যের কারণেই এটা সেমাই-এর ঈদ নামে প্রচলিত হয়ে গেছে। ঈদের দিন বের করা হতো আনন্দ মিছিল। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি চলতো এই মিছিল। মিছিলে থাকতো জমকালো কায়দায় সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, উট, পাল্কি। বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ছিল কাড়া-নাকাড়া, শিঙা, রং-বেরংয়ের পতাকা। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে পতাকা হাতে নিয়ে মিছিলে সে কি নৃত্যের জোয়ার! সবার মাথায় পরা থাকত জড়োয়া পাগড়ি। ত্রিশ-চলি্লশের দশকের ঈদের দিনে 'খাটকা' নাচ অনুষ্ঠিত হতো। বড় বড় ময়দানেই এসব নাচের আসর বসত। কাবুলিওয়ালা, মহাজন বা ফেরিওয়ালারা এই নাচের আয়োজন করত। বর্ষাকালে ঈদ হলে অনুষ্ঠিত হতো নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা! এছাড়াও সেকালে ঈদের দিন শিশু-কিশোরদের ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতারও আয়োজন হতো। আরো হতো মহল্লায় মহল্লায় হিজড়া নাচ, ঘোড় দৌড় ইত্যাদি। এ দিনের অন্যান্য খেলাধুলার মধ্য ছিল ঢাল-তলোয়ার, কুস্তি, এসব। নবাব-বাহাদুর, রাজা-প্রজা সবাই একসঙ্গে উপভোগ করত এসব প্রতিযোগিতা। এসবের চাইতেও বিচিত্র ছিল ঈদের দিনের খাবারের আয়োজন। খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শিরমলি, বাখরখানি, চাপাতি, নানরুটি, কাক্চা-বুলিচা, নানখাতাই, শিক-কাবাব, হাড্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোপ্তা, শাহী কাবাব, টিকিয়া, পরোটা, বোগদাদী রুটি, শরবতী রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবত ও নানারকম ফল। তবে ঈদের খাবারের মধ্যে বিখ্যাত ছিল 'তোরাবন্দি' খাবার। ধনী ও আমীর শ্রেণীর ব্যক্তিরাই এই দামি 'তোরাবন্দি' খাবারের আয়োজন করত। বর্ণনা অনুযায়ী তোরাবন্দি খাবার হচ্ছে এরকম_ 'নৌকা বানিয়ে তার উপরে লাল কাপড়ের নিীচ সারি সারি বর্তন ও পেয়ালা সাজিয়ে মেহমানদের সামনে তোরাবন্দি খাবার রাখা হতো। এই খাবারের মধ্যে থাকত চার রকমের রুটি, চার রকমের পোলাও, চার রকমের নানরুটি, চার রকমের কাবাব, পনির, বোরহানি, চাটনিসহ সর্বমোট ২৪ রকমের খাবার থাকত এতে। এছাড়াও বাড়িতে বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, সেলামী পাওনা ইত্যাদি তো সেই তখন থেকে আজো চলে আসছে।
**আলাউদ্দীন মজিদ**

0 comments:

Post a Comment