শ্রাবণ বা ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এ দিনটি পুণ্যের দিন। এদিন শ্রীকৃষ্ণ পাপ দমন ও ধর্মসংস্থাপনের জন্য দেবকী বাসুদেবের পুত্ররূপে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে এ দিনে শুধু উপাবাসেও সপ্ত জন্মকৃত পাপ বিনষ্ট হয়। আর তাই এ দিনটিতে তারা উপবাস করে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে কালের স্রোতে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় মিছিল ও শোভাযাত্রা। ক্রমেই জন্মাষ্টমী পালনের প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় মিছিল ও শোভাযাত্রা। কিন্তু ঠিক কবে থেকে এবং কেন জন্মাষ্টমী উৎসবে মিছিলের শুরু তার নির্দিষ্ট কোনো ইতিহাস জানা যায়নি।
মিছিলের পুরনো ইতিহাস লেখক ভুবন মোহন বসাক এবং যদুনাথ বসাকের দুটি বই থেকে জানা যায়। বই দুটির একটি ১৯১৭ সালে এবং অপরটি ১৯২১ সালের লেখা। দুটি বইয়ের তথ্যানুসারে জন্মাষ্টমী উৎসবে মিছিলের শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতকে। ভুবন মোহনের লেখা বই অনুসারে ইসলাম খাঁর ঢাকা নগরের পত্তনের (১৬১০ সাল) আগে বংশালের কাছে এক সাধু বাস করতেন। ১৫৫৫ সালে (ভাদ্র ৯৬২ বাংলা) তিনি শ্রী শ্রী রাধাষ্টমী উপলক্ষে বালক ও ভক্তদের হলুদ পোশাক পরিয়ে একটি মিছিল বের করেছিলেন। এর প্রায় ১০-১২ বছর পর সেই সাধু ও বালকদের উৎসাহে রাধাষ্টমীর কীর্তনের পরিবর্তে শ্রী কৃষ্ণের জন্মোপলক্ষে জন্মাষ্টমীর অপেক্ষাকৃত জাঁকজমকপূর্ণ একটি মিছিল বের করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল। সে উদ্যোগেই ১৫৬৫ সালে প্রথম জন্মাষ্টমীর মিছিল ও শোভাযাত্রা বের হয়। পরবর্তীতে এ মিছিলের দায়ভার এসে বর্তায় ঢাকার নবাবপুরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কৃষ্ণদাস বসাকের পরিবারের ওপর। কালক্রমে জন্মাষ্টমীর মিছিল একটি সাংগঠনিক রূপ ধারণ করে এবং প্রতি বছর জন্মাষ্টমী উৎসবের নিয়মিত অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। শ্রুত অনুযায়ী কৃষ্ণদাস স্বপ্নে 'শ্রী শ্রী বলরাম মূর্তি' দর্শন করেন এবং প্রত্যাদেশ বাক্য প্রতিপালনের জন্য মদন মোহন বিগ্রহ আনয়ন করেন এবং শ্রী শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ চক্রসহ তিনি এ বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১০৪৫ বঙ্গাব্দে কৃষ্ণ দাসের মৃত্যুর পর থেকে শ্রী শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ চক্রই এ উৎসবের আয়োজন শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে জন্মাষ্টমীর মিছিলকে উন্নত করে তোলেন। এরপর থেকে নবাবপুরের ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও জন্মাষ্টমী উপলক্ষে নিজ নিজ মিছিল বের করতে শুরু করে। কালক্রমে যা পরিচিত হয় উঠে 'নবাবপুরের মিছিল' নামে। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে ইসলামপুরের পানি্নটোলার কিছু ব্যবসায়ী ধনাঢ্য হয়ে উঠে এবং ভগবানের অনুসরণে তারা জন্মাষ্টমীর মিছিল বের করতে শুরু করেন। ১৭২৫ সালে জেমস টেলর উল্লেখ করেন যে, ওই সময় জন্মাষ্টমী পালনের জন্য দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। নবাবপুর পক্ষকে বলা হতো, লক্ষ্মীনারায়ণের দল আর ইসলামপুর পক্ষকে বলা হতো, মুরারি মোহনের দল।
সপ্তদশ শতকে মিছিলের শুরু হলেও তা বিকশিত হয়েছিল উনিশ শতকের শেষার্ধে। যে ধারা বলবৎ ছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। প্রথমদিকে মিছিলে নন্দঘোষ, রানী যশোদা, শ্রী কৃষ্ণ ও বলরামকে আনা হতো। ক্রমেই এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে আরো নানা ধরনের অনুষঙ্গ। তবে মূল কাঠামোটি ছিল প্রথমে নেচে-গেয়ে যাবে কিছু লোক, এরপর দেব-দেবীর মূর্তি, লাঠিসোঁটা, বর্শা, নিশান প্রভৃতি নিয়ে বিচিত্র পোশাক পরিহিত মানুষ, নানা রকমের দৃশ্য। সে সময় থেকেই কাগজ, রং, কাপড়, মোম, চুমকি ইত্যাদির ব্যবহার ছিল। মিছিলের প্রধান আকর্ষণগুলো ছিল সুসজ্জিত হাতি, ঘোড়া, রঙিন কাগজে মোড়ানো বাঁশের টাট্টি, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মন্দির, মঠ, প্রাসাদ, দুর্গ ইত্যাদি প্রস্তুত ও প্রাচীন কীর্তির প্রদর্শন। সেসব আয়োজন এখন শুধুই স্মৃতি। কিন্তু হাজার প্রতিকূলতার পরও ঢাকায় এখনো জন্মাষ্টমী উৎসব ও শোভাযাত্রা জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়।
Krishna Janmashtami Bangladesh |
0 comments:
Post a Comment